বিদ্যুৎ–জ্বালানির বাজেট সরকারের নীতিবিরোধী

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অব্যাহত উন্নয়নের জন্য কয়েক বছর ধরে সরকার যে নীতি অনুসরণ করছে, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট তার বিরোধী। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলোও এই ধারণা পোষণ করে। তাই এগুলো সংশোধনের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

মন্ত্রণালয়ের ওই সূত্রগুলো জানায়, কয়েক বছর ধরে সরকার আবাসিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে তরল পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর নীতি অনুসরণ করছে। সে অনুযায়ী এলপি গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছেও। বর্তমানে দেশে এলপি গ্যাসের ব্যবহার প্রায় চার লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। শহর-বন্দর থেকে গ্রাম পর্যন্ত এলপি গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে।

কিন্তু এর ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলে সিলিন্ডারের আকারভেদে কর বসবে ৫৪ থেকে ২৯৮ টাকা পর্যন্ত। ফলে দাম বাড়বে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত হচ্ছে ১২ কেজির সিলিন্ডার। বর্তমানে এই সিলিন্ডারের দাম দেশের সর্বত্র এক হাজার টাকার মধ্যে। সে ক্ষেত্রে এই সিলিন্ডারের দাম বাড়বে ১৫০ টাকা।

দেশে ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের প্রায় ৯৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। কাজেই এর দাম আন্তর্জাতিক বাজারনির্ভর। প্রতি মাসে এর দাম নির্ধারিত হয়। সেখানে এর দাম বাড়লে দেশেও সিলিন্ডারের দাম বাড়বে। সেই বাড়তি দাম অনুযায়ী বাড়বে মূল্য সংযোজন করও। ফলে গ্রাহকের ওপর আর্থিক চাপও বাড়তে থাকবে। এতে গ্রাহক এলপি গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ করতে থাকলে বা নতুন গ্রাহক এই গ্যাস ব্যবহারে আগ্রহী না হলে সরকারের এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর নীতি ব্যর্থ হবে।

মন্ত্রণালয় সূত্র বলে, সরকারের আরেকটি নীতি হচ্ছে নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশ ও ব্যবহার বাড়ানো। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী,
২০২১ সালের মধ্যে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, যার ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩ হাজার মেগাওয়াট হবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। আর দেশে এখন পর্যন্ত নবায়নযোগ্য শক্তির প্রধান উৎস সৌরশক্তি। এই সৌরশক্তি আহরণের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। এই প্যানেলের প্রায় ৯৫ শতাংশ আমদানি করা হয়। বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, এই প্যানেল আমদানির ওপর প্রায় ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক ও কর আরোপিত হয়েছে। ফলে সৌরবিদ্যুতের প্যানেলের দাম বাড়বে। এর প্রতি গ্রাহকের আগ্রহ কমবে।

বর্তমানে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ-চালিত সেচপাম্প চালু করা, সোলার মিনি গ্রিড স্থাপন এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ছাদে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল (ইন্ডাস্ট্রিয়াল রুফটপ সোলার) বসানোর প্রকল্প। এ ছাড়া গ্রিডে যুক্ত করার মতো বড় সৌরবিদ্যুতের প্রকল্পও রয়েছে। কর আরোপের প্রস্তাব কার্যকর হলে এর সব কটি প্রকল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সরকারের আরেকটি অগ্রাধিকার পাওয়া নীতি হলো ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব মানুষকে বিদ্যুৎ দেওয়া নিশ্চিত করা। সে অনুযায়ী বিদ্যুতের উৎপাদন সরবরাহ বাড়ছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করায় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। তা ছাড়া বিদ্যুতে এখনো সরকার ভর্তুকি দেয়। অর্থাৎ বিদ্যুতের প্রকৃত যে উৎপাদন মূল্য, তার পুরোটা গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া হয় না। একাংশ সরকার দেয়। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দামের এই অংশের জন্য যে ভ্যাট হবে, তা-ও সরকারকে দিতে হবে।

গ্যাসের দামও বাড়বে। সব শ্রেণির গ্রাহকের ক্ষেত্রেই গ্যাসের দামের সঙ্গে ৪২ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১৩ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত করা আছে। কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় এ ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে ১৫ শতাংশ। তাই অবশিষ্ট ২ শতাংশের সমপরিমাণ দাম বাড়বে।

সরকার গ্যাসের ঘাটতি পূরণের জন্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। এমনিতেই আমদানি করা এই গ্যাসের দাম দেশের বর্তমান দামের প্রায় দ্বিগুণ হবে। তার ওপর এলএনজিতেও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করায় গ্যাসের দাম আরও বাড়বে, যা সরকারের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নীতির বিরোধী।

এই এলএনজি আমদানি করে পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করে তা জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের জন্য ২০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন করা হচ্ছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জ্বালানি তেল ঢাকায় আনার জন্য পাইপলাইন করা হচ্ছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে আট ইঞ্চি ব্যাসের বেশি পাইপলাইনের জিনিসপত্রের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়েছে। এতে পাইপলাইনের ব্যয় অনেক বাড়বে।

বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের আরেকটি অনুসৃত নীতি হচ্ছে বিদ্যুৎ সাশ্রয়। এ জন্য সিএফএল বাল্বের ব্যবহার বাড়ানোর কাজ শুরু করা হয়েছে কয়েক বছর আগেই। এই বাল্বের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়েছে। আর এখন সরকার চায় আরও সাশ্রয়ী এলইডি বাল্বের ব্যবহার বাড়াতে। কিন্তু বাজেট প্রস্তাবে এই বাল্বের ওপর কোনো করের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে কেউ এলইডি বাল্ব আমদানি করতে গেলে নানামুখী জটিলতার মধ্যে পড়বেন।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এসব বিষয় জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় বিষয়গুলো উল্লেখ করে সংশোধন দাবি করা হবে।

সৌজন্যে: প্রথম আলো