শিল্পে বিদ্যুতের দাম কমছে!

শিল্পে বিদ্যুতের দাম কমনো হচ্ছে। তবে যারা কম মূল্যের বিদ্যুৎ নেবে তাদের শিল্পে ব্যবহার করা নিজস্ব বিদ্যুতে (ক্যাপটিভ) গ্যাস দেয়া হবে না।

অলস বিদ্যুৎ ব্যবহার, শিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুতে গ্যাস ব্যবহার কমানোর জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে করা কমিটি বিদ্যুতের দাম কমানোসহ কিছু সুপারিশ করেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, শিল্পে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ গড়ে ৬৭ পয়সা করে কমানোর সুপারিশ করেছে কমিটি। সুপারিশে বলা হয়েছে, বিদ্যুতের দাম কমানোর সাথে সাথে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে আলাদা নির্দিষ্ট সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন এর নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে।
কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ২৩০ কেভি লাইনের জন্য ৭ টাকা ২৩ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা এখন আছে ৮ টাকা ৩৬ পয়সা। ১৩২ কেভি লাইনের জন্য ৭ টাকা ২৮ পয়সা, যা এখন আছে ৮ টাকা ৩৬ পয়সা। ৩৩ কেভি লাইনের জন্য ৭ টাকা ৩৮ পয়সা, যা এখন আছে ৮ টাকা ৪১ পয়সা। ১১ কেভি লাইনের জন্য ৭ টাকা ৪৮ পয়সা প্রস্তাব করা হয়েছে। যা এখন আছে ৮ টাকা ৪০ পয়সা।

শিল্পে প্রস্তাবিত বিদ্যুতের দাম

ভোল্টেজ       প্রস্তাবিত দাম            বর্তমান দাম
                                              (টাকা/কি.ও.ঘ.)
২৩০ কেভি          ৭.২৩           ৮.৩৬
১৩২ কেভি          ৭.২৮           ৮.৩৬
৩৩ কেভি           ৭.৩৮          ৮.৪১
১১ কেভি            ৭.৪৮           ৮.৪০
কমিটি বলছে বিদ্যুতের দাম কমালে শিল্পে নিজস্ব বিদ্যুতে গ্যাসের ব্যবহার কমবে। এতে ২০২০-২১ সালে কমপক্ষে ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহ করা যাবে। আর তখন শিল্প গ্রাহকের দাম ৬৭ পয়সা কমালেও বিদ্যুৎ খাতের রাজস্বের কোন পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ লোকসান হবে না। শিল্পের বিদ্যুতের দাম কমলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এর যে আয় কমবে তা গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় পুষিয়ে যাবে। অর্থাৎ গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কম হবে।
কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, শিল্প গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য দাম কমানোর পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। এজন্য সঞ্চালন ও বিতরণ সংস্থা/কোম্পানিকে দুটো উৎসের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে শিল্পে সবসময় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। আগামী ২০ মাসের মধ্যে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে এখনই নির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা নিতে হবে। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রকল্প নিতে হবে।
যে সমস্ত শিল্প গ্রাহক কম দামের বিদ্যুৎ গ্রিড থেকে নেবে তারা যাতে ক্যাপটিভ প্ল্যান্টে আর গ্যাস সরবরাহ না পান তা নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে ক্যাপটিভ প্ল্যান্টে আর গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে না বলে বিদ্যুৎ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগের মধ্যে সমন্বয় হতে হবে।
সুপারিশে বলা হয়েছে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টে গ্যাস সরবরাহ উন্মুক্ত থাকলে ইতিমধ্যে স্থাপিত বিদ্যুৎ অলস অবস্থায় থাকবে। অপরদিকে শিল্প মালিকদের ক্যাপটিভ কেন্দ্র স্থাপন করে খরচ বেশি হবে। অর্থাৎ বিদ্যুতে দুই বার বিনিয়োগ করতে হবে। যা জাতীয়ভাবে আর্থিক অপচয়ের নামান্তর।
বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছর বিদ্যুতের ব্যবহার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শতকরা হিসেবে শুধু শিল্প ও কৃষিতে বিদ্যুতের ব্যবহার কমেছে। আর সব গ্রাহক বেড়েছে। ২০১০ সালে মোট বিদ্যুতের ৩৭ শতাংশ শিল্পে ব্যবহার হয়েছে। আর ২০১৯ সালে শিল্পে ব্যবহার হয়েছে ২৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। শিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহার শতকরা হিসেবে তুলনামূলক ব্যবহার কমলেও মোট ব্যবহার বেড়েছে। অন্যান্য গ্রাহকদের এই দশ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাণিজ্যিকে ২০১০ সালে ছিল ৯ শতাংশ আর ২০১৯ সালে ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। আবাসিক গ্রাহক ছিল ৪৭ শতাংশ আর ২০১৯ সালে হয়েছে ৫৩ দশমিক ৩১ শতাংশ। কৃষি খাতে ২০১০ সালে মোট বিদ্যুতের ৫ শতাংশ আর ২০১৯ সালে মোট বিদ্যুতের ২ দশমিক ১৮ ব্যবহার হয়েছে।
বিদ্যুতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শতকরা হিসেবে শিল্প ও কৃষিখাতে বিদ্যুতের ব্যবহার কমলেও আগের চেয়ে এখন মোট বিদ্যুৎ বেশি হচ্ছে। তবে একথাও বলছেন যে যদি যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হতো তাহলে শিল্প উৎপাদন বাড়ানো যেত তাতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হতো।
বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল সূত্র জানিয়েছে শুধু শিল্পে নয় সামগ্রিক বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। চলতি বছর সর্বোচ্চ চাহিদা সময় সর্বোচ্চ চাহিদা বলা হচ্ছে ১৪ হাজার ৭৫৭ মেগাওয়াট। আর আগামী বছর ২০২১ সালে এই চাহিদা হবে ১৬ হাজার ৮২৩ মেগাওয়াট। পর্যায়ক্রমে ২০২৫ সালে ২৫ হাজার ৯৫২ এবং ২০৩০ সালে ৩৭ হাজার ২৪ মেগাওয়াট হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম বলেন, নিরবিচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা করা হচ্ছে। গ্রাহকদের ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করে পরবর্তী কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হবে। নিরবিচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হবে। পরীক্ষামূলক গাজীপুরের তথ্য সংগ্রহ করে সেখানে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এবিষয়ে বিইপিআরসি তথ্য-উপাত্ত স়ংগ্রহ করছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সারাদেশে ৬৫টি শিল্প হাব বা অঞ্চল চিহ্নিতকরণ (২০০ কিলোওয়াট ও তদুর্দ্ধ লোড) করা হয়েছে। যেখানে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা ২ হাজার ৮২০ মেগাওয়াট । এর মধ্যে ঢাকার চারপাশে ৩২ শিল্পাঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা ১ হাজার ২৮৯ মেগাওয়াট ।

 

সংস্থাভিত্তিক শিল্পাঞ্চলগুলোর নাম ও অবস্থান:
বিউবো’র আওতাধীন ১৩টি শিল্পহাব:
চট্টগ্রাম অঞ্চল – ফৌজদারহাট, খুলশি, কালুরঘাট, বারবকুন্ড, ষোলশহর ও পটিয়া।
ময়মনসিংহ – বিসিক নগরী। কুমিল্লা – বিসিক নগরী (কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও বি-বাড়ীয়া)। সিলেট – বিসিক নগরী।
পবিবো’র আওতাধীন ২৮টি শিল্পহাব:
ঢাকা পবিস-১: চন্দ্রার মোড় ও নবীনগর নরসিংদী। পবিস-১: মাধবদী ও পাঁচদোনা।
ঢাকা পবিস-৩: সাভার, আশুলিয়া ও নরসিংদী। পবিস-২: চৌয়ালা, শিলমান্দী ও ইটাখোলা।
ঢাকা পবিস-৪: জিনজিরা, শুভাড্ডা ও কুমিল্লা। পবিস-৩: গজারিয়া, নারায়নগঞ্জ। পবিস-১: তারাবো, সোনারগাঁও, মদনপুর, কাঁচপুর ও মেঘনাঘাট। গাজীপুর পবিস-১: কাশিমপুর, বোর্ড বাজার, কড্ডা, জয়দেবপুর ও কোনাবাড়ী।
নারায়নগঞ্জ পবিস-২: মুড়াপাড়া ও ভুলতা/গাউছিয়া। গাজীপুর পবিস-২: রাজেন্দ্রপুর।
ময়মনসিংহ পবিস-২: ভালুকা ও মাওনা। টাঙ্গাইল পবিস : মির্জাপুর।
ডিপিডিসি’র আওতাধীন ৯টি শিল্পহাব:
(১) শ্যামপুর বিসিক নগরী এবং তৎসংলগ্ন এলাকা (২) আদমজী ইপিজেড (৩) তেজগাঁও শিল্প/বাণিজ্যিক এলাকা (৪) লালবাগ শিল্প/বাণিজ্যিক এলাকা (৫) সিদ্ধিরগঞ্জ ইন্ডাষ্ট্রিয়াল বেল্ট (৬) চরসৈয়দপুর ও মোক্তারপুর ইন্ডাষ্ট্রিয়াল জোন (৭) ফতুল্ল্যা ইন্ডাষ্ট্রিয়াল জোন (৮) মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা এবং (৯) কাওরান বাজার বাণিজ্যিক এলাকা।
ওজোপাডিকো’র আওতাধীন ৮টি শিল্পহাব:
রূপসা শিল্পাঞ্চল, মংলা শিল্প এলাকা, খাজানগর, কুষ্টিয়া বিসিক নগরী (বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও যশোর)।
নেসকো’র আওতাধীন ৭টি শিল্পহাব:
রাজশাহী জোন: রাজশাহী বিসিক, রাজশাহী হাইটেক পার্ক, পাবনা বিসিক, রাজশাহী জুট মিসল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
রংপুর জোন: বিসিক শিল্প এলাকা।