বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাস নেবে ভারত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র বেড়েছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের দুই প্রান্তে বিদ্যুৎ সঞ্চালন নেটওয়ার্ক এবং গ্যাস নেওয়ার পাইপলাইন নির্মাণে ঢাকা সম্মত হয়েছে। একই সঙ্গে ভারত থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানিরও বাড়তি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য কিছু অবাঞ্ছিত বাধা দূর হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে ভারত থেকে আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের খোলাবাজার থেকে এই বিদ্যুৎ কেনা হবে। এই বিদ্যুৎ আনার জন্য ভেড়ামারার গ্রিড উপকেন্দ্রটির সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ চলেছে।

ভারত আসামে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিহারে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের কাছে যে করিডর চেয়েছিল, ভারতকে তা দেওয়ার বিষয়টি এই সফরে নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দিনাজপুরের পার্বতীপুরে একটি গ্রিড উপকেন্দ্র করে তার মাধ্যমে আসামের বিদ্যুৎ বিহারে নেওয়া হবে। এই বিদ্যুৎ সঞ্চালনের নেটওয়ার্কটি হবে আসামের বর্ণ গড়-বাংলাদেশের পার্বতীপুর-বিহারের কাটিহার পর্যন্ত। এই নেটওয়ার্ক থেকে বাংলাদেশ এক হাজার মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে নিতে পারবে—এ বিষয়েও ভারত পূর্ণ সম্মতি দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় একটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল স্থাপনের বিষয়ে পেট্রোবাংলা ও ভারতের পেট্রোনেটের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এ ছাড়া কুতুবদিয়ায় ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেডের (আইওসিএল) একটি এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন, উত্তর-পূর্ব ভারতে এলপি গ্যাস সরবরাহের জন্য একটি পাইপলাইন স্থাপন এবং যশোর-খুলনা অঞ্চলে দ্রুত গ্যাস সরবরাহ শুরু করার পদক্ষেপ নিতে দুই প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, যশোর-খুলনা অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য আইওসিএল কলকাতা বন্দরের সন্নিহিত কোনো স্থানে এলএনজি টার্মিনাল বসিয়ে সেখান থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করবে।

আসামের নুমালীগড় শোধনাগার থেকে বাংলাদেশে ডিজেল আনার জন্য পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত পাইপলাইন স্থাপনের কাজ অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলায় দুই প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এই সফরকালে ভারত সড়কপথে ২ হাজার ২০০ মেট্রিক টন ডিজেল শিলিগুড়ি থেকে পার্বতীপুরে পাঠিয়েছে। এর আগে গত বছরের মার্চ ও ডিসেম্বরে এবং চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেও ওই পথে বাংলাদেশ ডিজেল এনেছে। পাইপলাইন না হওয়া পর্যন্ত সড়কপথে ডিজেল আসবে। শিলিগুড়ি-পার্বতীপুর পাইপলাইন স্থাপনে ভারত অর্থ বিনিয়োগ করবে (গ্র্যান্ট-ইন-এইড প্রজেক্ট)।

সফরকালে দুই প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত ৬০ মেগাওয়াট (১০০ মেগাওয়াট আগে থেকেই আসছে) বিদ্যুৎ সরবরাহ যৌথভাবে উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ শুরু হয়নি। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, গ্রিড উপকেন্দ্র ও গ্রিডলাইনের কারিগরি পরীক্ষা ও কিছু অপরিহার্য দলিলপত্র তৈরি করতে সময় লাগছে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বলেন, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যেই জাতীয় গ্রিডে ওই ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে।

ভারতীয় বেসরকারি খাতের বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হওয়ার প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে ভারতের বেসরকারি খাত উদ্যোগ নেবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এ প্রসঙ্গে ভারতের বেসরকারি খাতের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ও আদানির সঙ্গে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। রিলায়েন্স এখানে এলএনজি টার্মিনাল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র করবে। আর আদানি ভারতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে সেই বিদ্যুৎ বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করবে।

প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, যেসব নীতি ও শর্তের অধীনে ভারতের বেসরকারি খাত বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতও একই নীতি ও শর্তে ভারতে বিনিয়োগের সুযোগ চায়। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামনে থেকে বড় যে বাধাটি দূর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সেটি হলো ভুটান থেকে পানিবিদ্যুৎ আমদানি ও সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশের বিনিয়োগ। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় গত বছরের ৫ ডিসেম্বর ‘গাইডলাইনস অন ক্রসবর্ডার ট্রেড অব ইলেকট্রিসিটি’ প্রণয়ন করায় এই বাধার সৃষ্টি হয়। কারণ, ওই গাইডলাইনসে কেবল দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে ভুটান কিংবা নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিধান করা হয়।

কিন্তু ভুটান কিংবা নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনতে হলে ভারতের ভূমি ব্যবহার করা ছাড়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া ভুটান আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ রপ্তানিতে চুক্তিবদ্ধ। তাই ত্রিপক্ষীয় কোনো চুক্তি (বাংলাদেশ-নেপাল-ভারত কিংবা বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত) ছাড়া ভুটান কিংবা নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনা অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বা সেখানে বিনিয়োগের সমস্যার নিরসন হয়েছে।

দুই প্রধানমন্ত্রীর ৬২ দফা যৌথ ঘোষণার ২৮ নম্বর দফায় এ বিষয়ে তিন দেশের (বাংলাদেশ-ভারত ও নেপাল) মধ্যে সমঝোতা স্মারক সইকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যখন এই তিন দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বৈঠক করবে, তখনই এই সমঝোতা স্মারক সই হবে। তবে নেপালের বিষয়টি নিরসন হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেপালের বিষয়টি নিরসনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করেছেন।

শেখ হাসিনার সফরকালে জ্বালানি খাতের দক্ষতা বৃদ্ধি ও জ্বালানি সাশ্রয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) ও ভারতের এনার্জি এফিশিয়েন্সি সার্ভিসেস লিমিটেডের (ইইএসএল) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

২০১৫ সালে ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা প্রতিষ্ঠায় কিছু মৌলিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তার ভিত্তিতেই পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারণ, প্রকল্প গ্রহণ এবং চুক্তি-সমঝোতা স্মারক সই হচ্ছে।

এসব চুক্তি-সমঝোতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এর ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে। ভারতীয় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাংলাদেশের ব্যাপারে অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীদেরও আকৃষ্ট করবে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে সরকারি ও বেসরকারি খাতের যে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত হয়েছে, তাতে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করমুক্ত সুবিধা চাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যে বিদ্যুৎ বাংলাদেশ কিনবে, তার ওপর আরোপিত কর যেন মওকুফ করা হয়। এ বিষয়টিও ভারতের বিবেচনায় রয়েছে।