মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস পাইপলাইনের জাল

মুজিব মাসুদ:
মাটির নিচে অপরিকল্পিতভাবে জালের মত বিছিয়ে আছে গ্যাস পাইপলাইন। যার বেশিরভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ। সংস্কার না হওয়ায় প্রতিনিয়ত এতে ঘটছে দুর্ঘটনা। ভবিষ্যতেও কি অপেক্ষা করছে তা অজানা।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, নারায়নগঞ্জসহ বিভিন্ন শহরে গ্যাস পাইপলাইন ঠিত মত মেরামত না করায় তা এখন প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে।
অপরিকল্পিতভাবে যেখানে সেখানে ভবন হওয়ার সাথে সাথে ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে পাইপ ছিদ্র করে নিজেরা অবৈধ লাইন নিয়েছেন। যার কারণে বিভিন্ন স্থানের পাইপে প্রায়ই ছিদ্র থেকেই যাচ্ছে।
তিতাস গ্যাসের বেশিরভাগ পাইপলাইনের মেয়াদ কমপক্ষে ২০ বছর আগে শেষ হয়েছে। এসব পাইপের বিভিন্ন স্থানে ছিদ্র হয়েছে। যা দিয়ে প্রতিনিয়ত গ্যাস বের হচ্ছে। বাতাসে মিলে যাচ্ছে যেগুলো তা সরাসরি দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে না। তবে পরিবেশের ক্ষতি করছে। আর যেটা জমে থাকছে তা কোথায় কীভাবে জমছে তা অজানা।
১৯৭০ সাল থেকে এসব পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস বিতরণ হয়েছে। এখনও সেভাবেই চলছে। এসব লাইনের বেশিরভাগই এখনও কোন দিন মেরামত বা সংস্কার হয়নি।
১৯৭০ সালে যখন এই পাইপ স্থাপন করা হয়েছিল তখন এর কারিগরি সময় ধরা হয়েছিল ৩০-৩৫ বছর। সে হিসাবে তিতাসের ৬০ শতাংশের বেশি পাইপলাইনের বয়স ৫৫ থেকে ৬০ বছরের অধিক।
ঢাকা শহরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা গ্যাস পাইপলাইনের পরিপূর্ণ কোনো ম্যাপ নেই। অনেক এলাকায় স্থাপিত লাইনের ওপর রাস্তা কয়েক দফায় উঁচু করা হয়েছে। রাস্তা সরু হওয়ার কারণে একই পথে অন্যান্য সেবা সরবরাহ যুক্ত হয়েছে। এতে গ্যাসলাইনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাসাবাড়ির গ্যাস সংযোগে এক ইঞ্চি পাইপলাইন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকার অনেক গ্যাসের লাইন ছিদ্র হয়ে সেই গ্যাস স্যুয়ারেজ লাইন ও শৌচাগারের পাইপের মাধ্যমে ভবনে গিয়ে জমা হচ্ছে। বদ্ধস্থানে জমে থাকা এসব গ্যাস পরে বিস্ফোরণ কিংবা বৈদ্যুতিক স্পার্কের মাধ্যমে বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৬৭-৬৮ সালে ডেমরা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ১২ ইঞ্চি এবং ডেমরা থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ১৪ ইঞ্চি ও ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন মাটির নিচ দিয়ে বসানো হয়। এরপর সেখান থেকে দুই ইঞ্চি থেকে ছয় ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ নেটওয়ার্ক স্থাপন করে গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। নব্বই দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশে ৫০ পিএসআই চাপের বিভিন্ন ব্যাসের বিতরণ লাইন ছিল।
ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ১১ কোটি টাকার গ্যাস এভাবে উবে যায়। আর সেই গ্যাসের কিছু অংশ কোথায় কখন কিভাবে জমে থাকছে তা সকলেরই অজানা। যেন অজানা বোমা তৈরি হয়ে থাকছে শহরের মানুষের জীবনকে কাঁদাতে।
জমে থাকা গ্যাস আগুন, উচ্চতাপ বা অন্য কোনো গ্যাসের সংস্পর্শে এলেই ঘটছে বিস্ফোরণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস পাইপলাইনগুলো এখন একেকটি বোমায় পরিণত হয়েছে।
তিনটি কারণে গ্যাসের পাইপলাইনে লিকেজ হচ্ছে। অতি পুরোনো পাইপলাইন, পাইপলাইনে ঠিকভাবে জং প্রতিরোধী আবরণ না দেওয়া এবং মানহীন পাইপ ব্যবহার।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ মোল্লাহ জানান, পুরোনো জরাজীর্ণ গ্যাস বিতরণ লাইন প্রতিস্থাপন, বিদ্যমান লাইনে কোথাও ছিদ্র থাকলে সেগুলো চিহ্নিত করে মেরামতসহ বেশকিছু কাজের জন্য প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ কাজে একটি বিদেশি কোম্পানিকে জরিপের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা অস্থায়ীভাবে বন্ধ গ্যাস সংযোগ চিহ্নিত করেছে। রাজধানী ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ তিতাসের বিতরণ এলাকায় এমন আরও অস্থায়ীভাবে বন্ধ সংযোগ চিহ্নিত করার কাজ চলমান।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মাটির ক্ষার ও লবণের কারণে পাইপগুলো ক্ষয় হয়ে অধিকাংশ জায়গায় ছিদ্র হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় জং ধরে পাইপ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তৈরি হয়েছে হাজার হাজার ছিদ্র। এসব ছিদ্রপথে প্রায়ই গ্যাস বের হচ্ছে। এছাড়া অবৈধভাবে ফুটো করে গ্যাস সংযোগ দেওয়ায় বেশিরভাগ লাইনের অবস্থা জরাজীর্ণ। এর বাইরে প্রায় ৫০ হাজার সংযোগ রয়েছে যেগুলো সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করা রয়েছে। কিন্তু সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও গ্রাহক আঙ্গিনায় রাইজার রয়ে গেছে। তিতাসের অসাধু কর্মীরা রাতের আঁধারে এসব বিচ্ছিন্ন সংযোগ ফের চালু করে দিচ্ছে। যেগুলো পুরো তিতাস গ্যাসের নেটওয়ার্ককে বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এসব কারণে প্রায়ই তিতাসের পাইপলাইনে বিস্ফোরণ ঘটছে। কিন্তু তারপরও গ্যাসলাইন সংস্কারের উদ্যোগ নেই সরকারের। হাত গুটিয়ে বসে আছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি।
করোনাভাইরাসের আগে তিতাস গ্যাসের পুরো পাইপলাইন সংস্কারের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৪শ কোটি টাকা। কিন্তু ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
আবাসিক গ্যাস সংযোগ ২০১০ সাল থেকে বন্ধ থাকায় বেড়েছে অবৈধ সংযোগ। একারণেও দীর্ঘদিন বিতরণ নেটওয়ার্কের দিকে নজর কম। এতে ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে গ্যাস পাইপলাইনে এক ধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়। যাতে কোথাও লিকেজ হলে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং সাবধান হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু এ কার্যক্রম এখন বন্ধ থাকায় লিকেজ থেকে গ্যাস ছড়িয়ে পড়লেও কেউই তা জানতে পারছে না।
১৯৬৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে তিতাস গ্যাসের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। ৩০শে জুন ২০২২ অনুসারে তিতাসের মোট পাইপলাইন রয়েছে ১৩ হাজার ৩২০ কিলোমিটার। গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখেরও বেশি। মোট পাইপলাইনের মধ্যে ঢাকায় সাত হাজার কিলোমিটার।
৮০ এবং ৯০-এর দশকে এসে পাইপলাইন ব্যাপক সম্প্রসারণ করা হয়। তবে ২০০০ সালের পর লাইন সম্প্রসারণ অনেকটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর ২০১০ সালের পর থেকে নতুন পাইপলাইন খুব একটা বসানো হয়নি।
মাটির নিচে পাইপ দেওয়ার সময় এক ধরনের জং নিরোধক কালো প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হয়। কেউ যদি সেটি দিয়ে না মুড়িয়ে মাটির নিচে স্থাপন করে তাহলে পাইপে জং ধরে লিকেজ হতে পারে। এছাড়া পাইপের মানের ওপরেও অনেক সময় লিকেজ হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রায় ৫০ হাজার সংযোগ আছে যেগুলোর লাইন কেটে দেওয়া হলেও গ্রাহকের আঙ্গিনায় রাইজার রয়ে গেছে। এসব রাইজার ব্যবহার করে বেশকিছু গ্রাহক পরে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নিচ্ছেন। এগুলো থেকে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটছে।