ভোলায় গ্যাজপ্রমের কূপ খননের প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত

বাপেক্সের আবিষ্কার করা গ্যাস ক্ষেত্রে কূপ খনন নিয়ে আবার প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত।
দক্ষিণের দ্বীপজেলা ভোলার গ্যাস ক্ষেত্রটি আবিস্কার করেছে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স। প্রায় ২৫ বছর আগে। আবিস্কারের পর এখন পযর্ন্ত ৬টি কূপ খনন করা হয়েছে। এই ৬টি কূপের দৈনিক মোট উৎপাদন ক্ষমতা ন্যূনতম ১২ কোটি ঘনফুট। কিন্তু বিদ্যমান দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বর্তমানে ভোলায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট। এই তথ্য পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পাওয়া।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভোলার গ্যাস দেশের মূল ভূখণ্ডে সরবরাহের ব্যবস্থা না থাকায় দুটি কূপ থেকে গ্যাস তুলে সেখানকার চাহিদা মিটানো হচ্ছে। অবশিষ্ট ৪টি কূপ অলস পড়ে থাকছে। দেশের  মূল ভূখণ্ডে ভোলার গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা সরকারের আছে। তবে তা বাস্তবায়নে আরও অন্তত ৫ বছর লাগবে।

এই দুটি তথ্যের প্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন অযৌক্তিক নয় যে, ভোলা গ্যাস ক্ষেত্রে এখন আরও কূপ খনন জরুরি কেন? তাও আবার অতি উচ্চমূল্যে, বিদেশী কোম্পানিকে দিয়ে?

প্রশ্নটি উঠেছে এই কারণে যে, রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে রেকর্ড পরিমান উচ্চমূল্যে ভোলায় ৩টি কূপ খননের কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। গত কয়েকদিন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি বহুল আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে।

গ্যাজপ্রম গত বছরের ২৫শে মে ভোলার তিনটি কূপ (টবগি-১, ইলিশা-১ ও ভোলা নর্থ-২) খননের জন্য ৬ কোটি ৫০ লাখ (৬৫ দশমিক ০৮৫২১৭ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার দর প্রস্তাব করে। প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করার জন্য একটি কারিগরি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। এই উপ-কমিটি কয়েক দফা আলাপ-আলোচনা ও দর কষাকষি শেষে ৬ কোটি ৩৫ লাখ (৬৩ দশমিক ৫৮৫২১৮ মিলিয়ন) ডলার দর চূড়ান্ত করে তা জ্বালানি সচিবের নেতৃত্বাধীন প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটির (পিপিসি) কাছে উপস্থাপন করে। গত ২৭শে আগস্ট জ্বালানি সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পিপিসির সভায় এই দাম সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়। গত ৯ই সেপ্টেম্বর সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ করা হয়েছে।

এই কূপ তিনটি খননে অস্বাভাবিক ব্যয়ের যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, ভোলা ক্ষেত্রে গ্যাসের চাপ (রিজার্ভার প্রেসার) বেশি, ৪৫০০ থেকে ৫০০০ পিএসআই থাকায় সেখানে কূপ খনন করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া, এ কাজের জন্য গ্যাজপ্রমকে ড্রিলিং কন্ট্রাক্টরসহ ৬টি ইঞ্জিনিয়ারিং সেবা (ডিএসটি, সিমেন্টিং, মাড লগিং, ওয়ারলাইন লগিং, টেস্টিং অ্যান্ড কমপ্লিশন) বিভিন্ন স্থান হতে সংগ্রহ করতে হবে। কভিড-১৯ জনিত পরিস্থিতির কারনে সমুদ্র ও আকাশপথে চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় মালামাল ও জনবল আনা-নেওয়ার ব্যয়ও বাড়বে।

কিন্তু বাস্তবে হওয়ার কথা এর বিপরীত। কভিড-১৯ পরিস্থিতির কারনে পৃথিবীব্যাপী জ্বালানি অনুসন্ধানের কাজ শিথিল। অসংখ্য কোম্পানির রিগ অলস পড়ে আছে। থার্ড পার্টি সার্ভিস বন্ধ। জ্বালানির দামও অনেক কম। এই পরিস্থিতিতে কোনো কোম্পানি যদি কাজ করতে আগ্রহী হয় তাহলে তাকে আগের তুলনায় কম দামেই করতে রাজি হওয়ার কথা।

তাছাড়া, আলোচিত কূপ তিনটি বাপেক্স কিংবা অন্য কোনো কোম্পানি খনন করলেও উক্ত ইঞ্জিনিয়ারিং সেবাগুলো তাঁদেরও একই প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করতে হতো। আর এই কাজের জন্য বিদেশ থেকে হাজার হাজার টন মালামাল আনা কিংবা শত শত লোক আনা-নেয়ারও কোনো বিষয় নেই যাতে প্রতিটি কূপ খননের পিছনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় বেড়ে যাবে।

বাপেক্সের সূত্রে জানা যায়, বর্তমান কভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেও এর একেকটি কূপ খনন করতে বাপেক্সের ব্যয় হবে সর্বোচ্চ এক কোটি (১০ মিলিয়ন) ডলার (রিগ ভাড়া, জনবলের পিছনে ব্যয়, থার্ড পার্টির সেবাসমূহের ব্যয় প্রভৃতিসহ)। আর একটি বিদেশী কোম্পানি-আজারবাইজানের এরিয়েল, ভোলার এই তিনটি কূপের প্রতিটি গড়ে এক কোটি ৬০ লাখ (১৬ মিলিয়ন) ডলারে খননের একটি অযাচিত (অনসলিসিটেড) প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সে প্রস্তাব আমলে নেয়নি। যদিও গ্যাজপ্রম ২০১২ সাল থেকে তিন পর্যায়ে যে ১৭টি কূপ বাংলাদেশে খনন করেছে, গ্যাজপ্রমের ঠিকাদার হিসেবে সেগুলো সবই করেছে এই এরিয়েল।

বাংলাদেশে উৎপাদন অংশীদারত্ব চূক্তির অধীনে স্থলভাগের তিনটি ব্লকে (১২, ১৩ ও ১৪) দীর্ঘদিন কর্মরত আমেরিকান কোম্পানি শেভরনের প্রতিটি কূপ খননে গড় ব্যয় এক কোটি ৭০ লাখ ডলারের মত। গ্যাজপ্রম এর আগে একাধিক চুক্তির আওতায় মোট ১৭টি কূপ খনন করেছে। এরমধ্যে প্রথম ১০টির চুক্তিমূল্য ছিল প্রায় ১৯ কোটি ৩৫ লাখ (১৯৩ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার। অর্থাৎ প্রতিটি কূপের চুক্তিমূল্য ছিল এক কোটি ৯০ লাখ (১৯ মিলিয়ন) ডলারের কিছু বেশি।এরপর সর্বশেষ যে কূপগুলো গ্যাজপ্রম খনন করেছে তার প্রতিটির চু্ক্তিমূল্য ছিল এক কোটি ৬৮ লাখ (১৬ দশমিক ৪৮) মিলিয়ন ডলার।

এরপর, ২০১৮ সালের ৩০শে আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য বর্তমান ৩টি কূপ খননের যে প্রস্তাব সারসংক্ষেপ আকারে পাঠায় তাতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয় যে, গ্যাজপ্রম ‘হ্রাসকৃত মূল্যে’ এই তিনটি কূপ খনন করবে। প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। কিন্তু এখন ৩টি কূপের যে চুক্তিমূল্য চূড়ান্ত করা হয়েছে তা বাংলাদেশে গ্যাস কূপ খননে সর্বোচ্চ মূল্যের রেকর্ড করেছে। আর গ্যাজপ্রমকে এই কাজ দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায়, অযাচিত প্রস্তাবের ভিত্তিতে।

গ্যাজপ্রমকে এর আগের ১৭টি কূপ খননের কাজও একই পদ্ধতিতে দেয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য কোম্পানির কূপ খননের ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে গ্যাজপ্রমের প্রস্তাব যৌক্তিক হিসেবে দেখানো হতো। এবার তাও করা হয়নি।

সর্বোপরি বলা যায়, এই তিনটি কূপ খননের ব্যয় বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে কারিগরি উপ-কমিটি কিংবা পিপিসি গ্যাজপ্রমের বয়ানে যে কথাগুলো বলেছে, প্রকৃত অবস্থা যদি তেমনই হয় তাহলে এখন ভোলায় অতি উচ্চমূল্যে এই কূপ তিনটি খনন করার দরকারই বা কি? ভোলায় এখন যে ৪টি কূপ অব্যবহৃত পড়ে আছে, সেইভাবেই নতুন তিনটি কূপও অনির্দিষ্টকাল অব্যবহৃতই থাকবে। অদূর ভবিষ্যতে ওই সব কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ সম্ভব হবে না। ভোলায়ও আগামী ৫/৭ বছরে এত গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা অসম্ভব হবে। সুতরাং এখন ভোলায় এই কূপগুলো খননের কোনো যুক্তি কিংবা কার্যকারীতা নেই।

তথাপি, পিপিসির সিদ্ধান্তে উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন লাভের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী, তিনটি কূপ খননের এই সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় হয়ে ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে যাবে। সেখানকার অনুমোদনের পর চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নে গ্যাজপ্রমের সহযোগিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হতে পারে। সেই লক্ষ্যেই রাশিয়ার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল। আমাদের চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনুসন্ধান, বিদ্যমান ক্ষেত্রসমূহে গভীর কূপ খনন, সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধান প্রভৃতি হতে পারে এই সহযোগিতার কার্যকর ক্ষেত্র। তার পরিবর্তে বাপেক্সের আবিস্কৃত ক্ষেত্র, বিশেষ করে ভোলা এবং অন্যান্য বিদ্যমান ক্ষেত্রে বেশি দামে কূপ খনন করার মনোবৃত্তি গ্যাজপ্রমের যেমন থাকা অনুচিৎ তেমনি সরকারেরও উচিৎ এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা।

গ্যাজপ্রম পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান।২০১০-১১ সাল থেকে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নে গ্যাজপ্রমের সহযোগিতা করার কথা-বার্তা চলছে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। এই সহযোগিতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের হাইড্রোকার্বন ফিল্ডস ডেভেলপমেন্ট, একটি সিঙ্গেল গ্যাস সাপ্লাই সিস্টেম তৈরি প্রভৃতি মৌলিক কাজের জন্য গ্যাজপ্রমের বিনিয়োগ করার কথা। বাপেক্সের সঙ্গে জেভি করে এ দেশের পাহাড় ও সমুদ্র অঞ্চলে কাজ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে গ্যাজপ্রম বাংলাদেশের বিদ্যমান গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে উচ্চমূল্যে কূপ খননের ঠিকাদারী করতেই বেশি আগ্রহী। বিষয়টি বাংলাদেশে গ্যাজপ্রমের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।

আমরা জানি যে, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে রাশিয়ার সহযোগিতার বিষয়টি দুই দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের যৌথ সতঝোতার অংশ। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে আনসলিসিটেড পদ্ধতিতে কূপ খননের ঠিকাদারী পাওয়ার জন্য লবিস্ট নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা কেন?

ভোলা বাপেক্সের আবিস্কৃত ও উন্নয়ন করা একটি সমৃদ্ধ গ্যাসক্ষেত্র। অথচ গ্যাজপ্রম সেখানেই কূপ খনন করতে বেশি আগ্রহী। বাপেক্স ও গ্যাজপ্রমের মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এই বিষয়ে ২০১১ সাল থেকে কথা-বার্তা হয়ে আসছে। কিন্তু একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে এ বছর (২০২০ সাল)। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, গ্যাজপ্রমের কি আদৌ কোনো পরিকল্পনা আছে বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ অংশীদারীত্বে কাজ করার এবং বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করার?