বিদ্যুতের গ্রাহক চার কোটি ছাড়াল

রফিকুল বাসার:
দেশে বিদ্যুতের গ্রাহক চার কোটি ছাড়াল। ‘সবার ঘরে বিদ্যুৎ’ আর ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ কর্মসূচিতে এই মাইলফলক। এখন আর বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়না। তা সে হোক শিল্প বাণিজ্য কিম্বা আবাসিক। কিছু ভোগান্তি থাকলেও আবেদন করলেই এখন বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় গ্রামের মানুষের জীবনমান পরিবর্তন হয়েছে। কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। আরইবি’র এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুতায়িত শিল্পে অবিদ্যুতায়িত শিল্পর চেয়ে ১১গুণ কর্মসংস্থান হয়েছে।
বিতরণ সংস্থা আর কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে নেয়া তথ্য অনুয়ায়ি চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত বিদ্যুতের গ্রাহক ৪ কোটি ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৯৪টি। আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, সেচসহ সব গ্রাহকই এরমধ্যে আছে।
বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিদ্যুতের জন্য আবেদন করে এখন আর অপেক্ষা করতে হয় না। প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিলেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংযোগ দেয়া হয়।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এর গ্রাহক ৩ কোটি ১৭ লাখ ৬৯ হাজার ৮৯০টি। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর গ্রাহক ৩৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৫টি। নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের গ্রাহক ১৬ লাখ ৮০ লাখ। ঢাকা পাওয়া ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এর গ্রাহক ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ১১৩। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) এর গ্রাহক ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ২৪৯ এবং ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) এর গ্রাহক ১০ লাখ ৮১ হাজার ৮৪৭টি।

  • এক নজরে বিদ্যুৎখাত
    (পাওয়ার সেলের দেয়া জুলাই মাসের হিসাব অনুযায়ী)
  • বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী (%) ৯৯
    বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১২২
    অবসরকৃত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ৬
    সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন (মে.ও.) ১৩৭৯২
    বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা (মে.ও.) ২৫২২৭
    সঞ্চালন লাইন (সা.কি.মি.) ১২৭৪৪
    গ্রিড সাব-ষ্টেশন ক্ষমতা (এমভিএ) ৫০০৭৪
    বিদ্যুৎ আমদানি (মে.ও.) ১১৬০
    বিতরণ লাইন (কি.মি.) ৬১২০০০
    মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন (কি.ও.ঘণ্টা) (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ) ৫১২
    সেচ সংযোগ সংখ্যা ৪৪৬০০০
    বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বরাদ্দ (কোটিতে) ২৩৭৬০
    বিদ্যুৎ বিতরণ সিষ্টেম লস (%) ৮.৭৩

সরকারি-বেসরকারি মিলে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় অর্থাৎ সন্ধ্যায় এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে গড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎ পিডিবি নিয়ে বিভিন্ন বিতরণ সংস্থা ও কোম্পানির মাধ্যমে সারাদেশে সরবরাহ করছে। এই হিসাবে গ্রাহকের মত সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে আরইবি। মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের অর্ধেকের বেশি আরইবি’র। আরইবি মোট বিদ্যুতের ৫১ দশমিক ২১ ভাগ সরবরাহ করে। আর পিডিবি গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করে ১৬ দশমিক ৪৩ ভাগ। এরপর পর্যায়ক্রমে ডিপিডিসি ১৩ দশমিক ৪৩ ভাগ, ডেসকো ৮ দশমিক ০১ ভাগ, ওজোপাডিকো ৫ দশমিক ১০ ভাগ এবং নেসকো ৫ দশমিক ৮২ ভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। অর্থাৎ দেশে সরবরাহ করা বিদ্যুতের প্রায় অর্ধেক গ্রামে ব্যবহার হয়।
অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আবাসিক গ্রাহক। মোট বিদ্যুতের ৫৭ দশমিক ০২ শতাংশ বিদ্যুৎ আবাসিকখাতে। শিল্পে ব্যবহার হয় ২৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বাণিজ্যিকে ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ আর কৃষিতে ২ দশমিক ৪২ শতাংশ। বাকি ২ দশমিক ৪২ শতাংশ অন্যান্যখাতে ব্যবহার হচ্ছে।
দেশে ৯৯ ভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌছে গেছে। সমতলের সকল জেলা উপজেলার শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে।
চার কোটি গ্রাহক তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে আরইবি। প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুতের বিতরণ লাইন পৌঁছে দিয়েছে। আরইবি’র আওতায় থাকা ৪৬২টি উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে।
‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ কার্যক্রমে এই বিদ্যুৎ পৌছে দেয়া হয়েছে। মোট গ্রাহকের ৮০ভাগই গ্রামের অর্থাৎ আরইবি’র। আরইবি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে ৭৪ লাখ গ্রাহককে সংযোগ দিয়েছিল। এরপর বর্তমান সময় পর্যন্ত ১২ বছরে প্রায় ২ কোটি ৪৪ লাখ সংযোগ দিয়েছে। গ্রামের ২৭ ভাগ থেকে এখন ৯৯ ভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌছে গেছে।
আরইবি প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা, ১৩ হাজার ৫০০টি মাঝারি শিল্প কারখানা, ৩৭৫টি শিল্প কারখানায় এবং ৮টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে।
দুর্গম, প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে অবস্থিত অফগ্রিডের পটুয়াখালির রাঙ্গাবালি উপজেলাসহ ১ হাজার ৫৯টি গ্রামে শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম চলছে। পল্লী বিদ্যুতের শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমে এই অঞ্চলগুলোকে অন্তর্ভূক্ত করায় বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে প্রত্যন্ত এলাকার প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ গ্রাহক। বাংলাদেশের একমাত্র অফগ্রিড উপজেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালিতেও বিদ্যুৎ পৌঁছে যাচ্ছে। এই ১ হাজার ৫৯টি গ্রামে ৩ ধাপে এ বিদ্যুতায়নের কার্যক্রম চলছে।
আরইবি জানিয়েছে, ১ম ধাপের ৬৪৬টি গ্রাম তুলনামূলকভাবে কম প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এগুলোতে চলমান বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম প্রায় শেষের পথে। এর বাইরে ২৯টি অতিদুর্গম গ্রাম বাদে বাকি ৩৮৪টি গ্রামে বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম চলছে। ১ হাজার ৩০টি গ্রাম সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে গ্রিডের সাথে সংযুক্ত হবে।
বর্তমানে আরইবি’র আওতায় ৩ লাখ ৫৩ হাজার সেচ গ্রাহক আছে। যারা প্রায় ৫৫ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল ফলাতে পানি দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের’ আওতায় ভূমিহীন, গৃহহীন অসহায় জনগণকে পুনর্বাসিত করার ১ হাজার ১৯২টি প্রকল্প-গ্রামে ৮৫ হাজার ৫৭০টি পরিবারকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়াও গ্রামের প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। এতে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সেবার মান বেড়েছে। ৪ হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল ইনফরমেশন সেন্টারে সংযোগ দিয়ে গ্রামেও তথ্য ও সেবা প্রাপ্তির জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি পৌঁছানো গেছে। আরইবি ৫৬ হাজার ১৭২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ২ লাখ ৫১ হাজার ২৮৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে।
আরইবি’র চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন বলেন, পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুতায়নের ফলে নতুন নতুন পোলট্রি খামার, মৎস্য খামার, ডেইরী খামার, ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প, কল-কারখানা, কুটির শিল্প, তাঁত শিল্প, ছোট-বড় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে যেমন বেকারত্ব কমছে, অন্যদিকে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। তিনি বলেন, ডিজেলের চেয়ে বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রপাতি বেশি কার্যকর এবং একই খরচে ১০ গুণ বেশি চাষাবাদ সম্ভব। বিদ্যুৎ সুবিধার ফলে পল্লী এলাকায় উৎপাদিত পণ্য বাজার ব্যবস্থাপনায় উন্নতি হয়েছে। এভাবে, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়নে আরইবি ভূমিকা রাখছে।