প্রতি বছর উবে যাচ্ছে তিতাসের ৪৫ কোটি ঘনমিটার গ্যাস

তিতাসের বিতরণ নেটওয়ার্ক থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪৫ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উবে যাচ্ছে বা উধাও হয়ে যাচ্ছে। এই হিসাব গত ৫ বছরের। কর্তৃপক্ষের দাবি, দীর্ঘদিনের পুরনো জরাজীর্ণ পাইপে অজস্র ছিদ্র এবং অবৈধ সংযোগ এই উধাও হওয়ার প্রধান কারণ। এসব কারণ নিরসনে তাঁদের উদ্যোগ আছে। তবে তার বাস্তবায়ন যথেষ্ঠ সময়সাপেক্ষ ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

তিতাসের সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এক বছরে যে পরিমান গ্যাস উবে যায় তা দিয়ে তাঁদের বিতরণ নেটওয়ার্কভূক্ত ৩টি সার কারখানা ২ বছর চালানো যায়। আর গত ৫ বছরে যে গ্যাস উবে গেছে তা দিয়ে তিতাসের নেটওয়ার্কভূক্ত ১৭টি সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র এক বছর পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো যেত।

বর্তমান বাজার দরে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় দাম ১২ টাকা ৬০ পয়সা। সে হিসাবে প্রতি বছর উবে যাওয়া গ্যাসের আর্থিক মূল্য ৫৬৭ কোটি টাকা। এই গ্যাস পদ্ধতিগত (সিস্টেম লস) লোকসানে যুক্ত করা হয়।

তিতাস সূত্র জানায়, উবে যাওয়া গ্যাসের পরিমান বা সিস্টেম লস প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি। কেননা তাঁদের ২৭ লাখেরও বেশি মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকদের অব্যবহৃত গ্যাস আসলে কোম্পানির ‘সিস্টেম গেইন।’ সেটা হিসাবে না ধরেই উপরের সিস্টেম লস বা উবে যাওয়া গ্যাসের পরিমান নির্ধারণ করা হয়।

গত জুন পর্যন্ত তিতাসের মোট আবাসিক গ্রাহক ২৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩৫৯। এর মধ্যে দুই লাখ ১২ হাজার ৫০০ গ্রাহক প্রি-পেইড মিটারযুক্ত। এক লাখ ৫৪ হাজার ৯৯৬ গ্রাহক একচুলা ব্যবহারকারী। বাকী ২৪ লাখ ৮১ হাজার ৮৬৩ গ্রাহক দুইচুলা ব্যবহারকারী। যাদের প্রত্যেকে প্রতি মাসে ৭৭ দশমিক ৩৮ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করবেন ধরে নিয়ে বিল (মাসিক ৯৭৫ টাকা) করা হয়েছে। কিন্তু মিটারযুক্ত গ্রাহকদের ব্যবহার থেকে একথা নিশ্চিত যে, কোনো গ্রাহক মাসে ৪০ ঘনমিটারের বেশি গ্যাস ব্যবহার করেন না।

এইভাবে দুই চুলা ব্যবহারকারী গ্রাহকদের অব্যবহৃত গ্যাস তিতাসের নেটওর্য়াকেই থেকে যায়। যার পরিমান বছরে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ঘনমিটার (বিসিএম)। কিন্তু এর কোনো আলাদা হিসাব নেই। তাই এই গ্যাসও সিস্টেম লসের হিসাবে যুক্ত হওয়ায় প্রকৃত সিস্টেম লস কম দেখা যায়।

দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। ঢাকা মহানগরী ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জুড়ে তিতাসের বিতরণ নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। দেশে এখন প্রতিদিন যে পরিমান গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে (সর্বোচ্চ ৩৩০ কোটি ঘনফুট) তার অর্ধেকেরও বেশি বিতরণ করে তিতাস। তিতাসের দৈনিক চাহিদা এখন ২০০ কোটি ঘনমিটার। কিন্তু চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় তিতাস ১৮০ কোটির বেশি পায় না।

৫ বছর আগে তিতাসের কোনো সিস্টেম লস ছিল না। ছিল সিস্টেম গেইন যা একটি গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক। সেখান থেকে সিস্টেম লসের ধারায় ফেরার বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. আল-মামুন এনার্জি বাংলাকে বলেন, সবচেয়ে বড় কারণ গ্রাহকের ওপর ‘মিনিমাম চার্জ’ নামে আরোপিত দায়টি এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) আদেশ অনুযায়ী বন্ধ করে দেওয়া। এর আগে অনেক গ্রাহক গ্যাস ব্যবহার না করেও ওই মিনিমাম চার্জ দিতে বাধ্য হতেন। সেটা ছিল কোম্পানির বাড়তি আয়। এছাড়া ধারাবাহিকভাবে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাও একটা কারণ।

এখনো যে বিপুল সংখ্যক অবৈধ সংযোগ আছে, সেগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনো অবৈধ আছে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পাইপ লাইন এবং প্রায় এক লাখ চুলা। এগুলো ধারাবাহিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার কাজ চলছে।’

আর নেটওয়ার্ক জুড়ে জরাজীর্ণ পাইপ লাইন ও তাতে অজস্র ছিদ্রজনিত সমস্যা সমাধানে কার্যকর কী উদ্যোগ আছে জানতে চাইলে তিনি সরকারি অর্থায়নে ১২০০ কোটি টাকার পাইপ লাইন প্রতিস্থাপন প্রকল্প এবং তিতাসের নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ২০০ কিলোমিটার নতুন পাইপ লাইন নির্মান প্রকল্পের উল্লেখ করেন। তাঁর দাবি, এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে সমস্যা মিটবে। এর মধ্যে তিতাসের নিজস্ব অর্থায়নে নতুন পাইপ লাইন প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ করা যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

অবশ্য প্রায় এক বছর তিতাসের জরাজীর্ণ পাইপ লাইনের প্রসঙ্গ উঠলেই সরকারের পক্ষ থেকে ঐ এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ বিদ্যমান পাইপ লাইন প্রতিস্থাপন প্রকল্পের কথা বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এখন পর্যন্ত ওই প্রকল্পের ডিপিপি (খসড়া প্রকল্প প্রস্তাব) অনুমোদনও হয়নি। জানা গেছে, ২০১৮ সালে প্রকল্পটি নেয়া হলেও এখন কেবল পেট্রোবাংলা থেকে ডিপিপি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে যাবে পরিকল্পনা কমিশনে। সেখানে অনুমোদন পাওয়ার পর শুরু হবে বাস্তবায়নের পর্যায়। সর্বোপরি এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকৃতপক্ষে কতদিন লাগবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। সংশ্লিষ্টদের ধারণা ১০ বছরও লাগতে পারে।

গ্যাসের গ্রাহকস্বার্থ সংশ্লিষ্ট আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রি-পেইড মিটার স্থাপন। প্রায় ৫ বছর আগে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় গ্যাস ও বিদ্যুতের সব শ্রেণির গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনার। তারপর প্রধানমন্ত্রীর র্কাযালয় থেকে এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। তখন থেকে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হলেও সব ক্ষেত্রেই গতি অত্যন্ত ম্লথ। তাই অগ্রগতি খুব কম।

তিতাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তার প্রায় সাড়ে ২৮ লাখ আবাসিক গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনা। তিতাসের এমডি জানান, এখন র্পযন্ত তাঁরা ২ লাখ ১২ হাজার ৫০০ গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটার দিয়েছেন। আরও এক লাখ ২০ হাজারের একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এছাড়া জাপান ব্যাংক অফ ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন (জেবিআইসি)-এর অর্থায়নে, এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে।

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এর পরও বাকি থাকবে প্রায় ২০ লাখ আবাসিক গ্রাহক। এই গ্রাহকদের প্রি-পেইড মিটার দিতে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন যা সংস্থানের কোনো উৎস এখন র্পযন্ত অনিশ্চিত। তাই এখন এ বিষয়ে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্রি-পেইড মিটার স্থাপিত হলে গ্যাস খাতে চুরি, অপচয়, অবৈধ ব্যবহার বন্ধ হয়ে শৃংখলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হতে পারে। সেই উদ্দেশ্যেই সরকার প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এর বাস্তবায়নে শ্লথ গতি গ্রাহকদের জন্য হতাশার। কারণ মিটার বিহীন গ্রাহকেরা ব্যবহারের তুলনায় অনেক বেশি টাকা বিল পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

শিল্প গ্রাহকদের ইভিসি (ইলেকট্রনিক ভলিউম কারেক্টার) মিটার দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই ধরণের অভিযোগ রয়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানে ইভিসি মিটার স্থাপন করা হলে বড় ধরণের গ্যাস চুরি ও দুর্নীতি বন্ধ হত। তা না হওয়ায় ব্যবহৃত গ্যাসের চেয়ে অনেক বেশি বিল পরিশোধে বাধ্য হচ্ছেন শিল্প মালিকেরা। এ প্রসঙ্গে তিতাসের এমডি বলেন, সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে প্রতি ঘন্টায় ৫ হাজার ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার হয় এবং যাদের কোনো গ্যাস বিল বকেয়া নেই তাঁদের প্রত্যেককেই এখন ইভিসি মিটার দেওয়া হবে।

বিদ্যমান পাইপ লাইন প্রতিস্থাপন, নতুন পাইপ লাইন নির্মাণ, সব গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনা, শিল্প প্রতিস্ঠানে ইভিসি মিটার স্থাপন-এ সবই তিতাসের গ্যাস উধাও হয়ে যাওয়া রোধ করার জন্য অতি আবশ্যিক কাজ।কিন্তু এর প্রতিটি কাজের গতি প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত ধীর।

জানতে চাইলে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান এনার্জি বাংলাকে বলেন, পাইপ লাইনের ছিদ্র দিয়ে গ্যাস উবে যাওয়া বন্ধ করার জন্য পাইপ লাইন প্রতিস্থাপন, প্রি-পেইড মিটার এবং ইভিসি মিটার স্থাপন-এই কাজ শেষ না হলে প্রকৃত সিস্টেম লস এবং অপচয়ের যথাযথ হিসাব জানা সম্ভব হবে না। তাই এই কাজগুলো দ্রুত শেষ করা দরকার। আগামী বছর তিনেকের মধ্যে যাতে এই কাজগুলো শেষ করা যায় সেই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ জন্য প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ, ছোট ছোট এলাকাভিত্তিক কাজ ভাগ করে দেয়া এবং আরও কিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে। সরকার এই অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলো দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার বিষয়ে কাজ করছে।