নাইকো বিজয়: একটি পর্যালোচনা

জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একটি আলোচিত মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের বিজয় এখন আর নতুন খবর নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।এ বিজয়ের জন্য ওই মন্ত্রণালয় তথা সরকার দেশি-বিদেশি আইনজীবী প্যানেলের সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সবাইকে আমরা অভিনন্দন জানাই।
বাংলাদেশ এর আগেও জ্বালানি বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে জয় পেয়েছে, সিমিটার মামলায়। কিন্তু নাইকোর বিরুদ্ধে এবারের জয়ের একটি আলাদা মাহাত্ম্য আছে। কেননা এই মামলাটিতে বাংলাদেশ আসলে বলা যায় হারতে হারতে জয়ী হয়েছে। মামলার এক পর্যায়ে যখন জয়ের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নতুন করে উদ্যোগ নেন।
তার অংশ হিসেবে এই মামলায় দেশীয় আইনজীবী পরিবর্তন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান আইনি প্রতিষ্ঠান ফলকে যুক্ত করা হয়। তারা আইনি লড়াইয়ের কৌশল পরিবর্তন করে, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের সঙ্গে নাইকোর চুক্তি সম্পাদনে দুর্নীতি হয়েছে মর্মে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ নিয়ে আদালতে হাজির হন। ফলে প্রায় পুরো মামলাটির নতুন করে শুনানি শুরু হয় এবং মামলার মোড় ঘুরে যায়। তাই এই মামলার জয়ে একটা ভিন্ন মাত্রা আছে।
কিন্তু টেংরাটিলাসহ বাংলাদেশের কয়েকটি প্রান্তিক ক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলার কাজ পাওয়ার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগে কানাডার আদালতে নাইকো দোষী সাব্যস্ত হয়ে শাস্তি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে কোম্পানিটি দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাই একটি দেউলিয়া কোম্পানির কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ আদায়ে অনিশ্চয়তা থাকেই।
সে ক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশকে নাইকোর যে সম্পদ আছে তা নিয়েই খুশি থাকতে হবে। এই সম্পদের মধ্যে রয়েছে কুমিল্লার ব্লক নয় এর ৬০ শতাংশ মালিকানা এবং ফেনী গ্যাস ক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম যা সুদ-আসলের সর্বোচ্চ চার কোটি ডলার বা ৩৫০ কোটি টাকার মতো। ব্লক ৯ এ নাইকোর মালিকানার আর্থিক মূল্য কত হবে তা নিকাশ করে দেখার বিষয়।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে নাইকো দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে বলে বাংলাদেশ যে অভিযোগ করেছে এবং তথ্য প্রমাণ দিয়েছে সে বিষয়ে আদালতের আংশিক রায়ে কিছু বলা হয়েছে কিনা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্র বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিষয়ে আদালতের বক্তব্য থাকবে। তবে কানাডার আদালতে দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় এ বিষয়ে আর কারও কোন সন্দেহ বা ভিন্নমত থাকার কথা নয়।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের একটি বিশেষ আদালতেও
নাইকো দুর্নীতি একটি মামলা চলমান আছে।
নাইকোর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকালীন (২০০৩ সাল) সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন প্রমুখ এই মামলায় অভিযুক্ত।
অবশ্য মামলার কার্যক্রম একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। কানাডীয় কোম্পানি নাইকো রিসোর্সেস আদালতে গিয়েছিল ছাতকের টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে দুই দফা বিস্ফোরণের জন্য তারা দায়ী নয় এই মর্মে দায়মুক্তির আর্জি নিয়ে। নাইকোর এই দাবি আদালত নাকচ করে দিয়েছে।
আদালত বলেছে, নাইকোর অদক্ষতা কিংবা অবহেলায় দুর্নীতির জন্য দায়ী। সুতরাং বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ পাবে।
কিন্তু ক্ষতিপূরণের অর্থের পরিমাণ কত হবে তা আদালত এখনও নিষ্পত্তি করেনি। কারণ, বাংলাদেশে দুর্ঘটনার জন্য নাইকোকে দায়ী করে আদালতে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল একশ’ কোটি মার্কিন ডলারের কিছু বেশি বা প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।কিন্তু আদালতের নির্দেশনা হচ্ছে বাংলাদেশের দাবীকৃত ওই ক্ষতির মধ্যে পরিবেশ জনস্বাস্থ্য ও অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ উপযুক্ত কোন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে প্রাক্কলন করে আদালতে দাখিল করতে হবে। বাংলাদেশ এখন সেই কাজটি শুরু করেছে। আদালতে সেটি দাখিল করার পর এ বিষয়ে একটি শুনানি হবে। তারপর পাওয়া যাবে চূড়ান্ত রায়। কেবল তখনই জানা যাবে বাংলাদেশে কত ক্ষতিপূরণ পাবে। বাংলাদেশের পক্ষের এই মামলার আইনজীবী মঈন গনি বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরে সেই শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতির কারণে তা পিছিয়ে যেতে পারে। আগামী বছরের মাঝামাঝি কোন সময় সেটি হতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো আদালতের রায় পেলেই কি ক্ষতিপূরণের অর্থ পাওয়া নিশ্চিত? ইকসিড বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিশ্বব্যাংকের সদস্য দেশগুলো এবং সেসব দেশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো এই আদালতের রায় মান্য করে। সে দিক থেকে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার কোনো অনিশ্চয়তা ছিল না।
২০০৫ সালে সিলেটের ছাতকের টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের সময় পরপর দুই দফা বিস্ফোরণ হয়। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মান সম্মত ভাবে কাজ না করায় এই বিস্ফোরণ ঘটে।