নদী বাঁচাও

বিশ্ব পরিবেশ দিবস, বিশ্ব জলাভূমি দিবস এবং বিশ্ব পানি দিবস- এসব দিবস পালনে রাষ্ট্রীয় ও জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে এবং এসব দিবস আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়। কিন্তু বিশ্ব নদী দিবস সে রকম নয়। এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়। তাহলে নদী সংরক্ষণে, নদীর প্রবাহের পরিমাণ নিশ্চিত করতে এবং নদীর পানির গুণগত মান বজায় রাখার বিষয়ে বাংলাদেশের কি কোনো অঙ্গীকার নেই? এ প্রশ্নে আমার উত্তর হল, এ বিষয়ে বাংলাদেশের অঙ্গীকার অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও স্পষ্ট। কিন্তু এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সঠিক ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। এ বক্তব্য বিশ্লেষণে প্রথমে এ বিষয়ক অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের জন্য আইনি ধারার দিকে নজর দিই।

২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে ১৮(ক) ধারা সংযোজিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র প্রকৃতি, বনভূমি, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি ইত্যাদি সংরক্ষণে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। লক্ষণীয়, নদী শব্দটি এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্রতিটি নদীই জলাভূমি। অর্থাৎ আইন প্রণেতারা নদী সংরক্ষণ করতে হবে- এ কথাটা সরাসরি বলতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু জলাভূমি শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করে তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে নদীগুলো রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। দ্বিতীয় আইনটি হচ্ছে ২০১৩ সালের পানি আইন। এ আইনে ভূমি উপরিস্থিত পানিসহ সব ধরনের পানিকে দূষণমুক্ত রাখতে সুর্নিদিষ্ট ধারা অন্তর্ভুক্ত করতে এবং এ ক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ আইন বাস্তবায়নের জন্য দিকনির্দেশনা দিতে জাতীয় পানি কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। তৃতীয় আইনটি হল ২০১৩ সালের নদী সংরক্ষণ আইন। অর্থাৎ আইনপ্রণেতারা সরাসরি নদীর অবয়ব এবং নদীর পানির গুণগত মান সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়েছেন। লক্ষণীয়, আইনে সরাসরি নদী সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। চতুর্থ আইনটি হল ১৯৯৫ সালের প্রকৃতি সংরক্ষণ আইন। আইন বাস্তবায়নের জন্য যথোপযুক্ত ধারা-উপধারা রচিত হয় ১৯৯৭ সালে। এরপর ২০১০ সালে আইনটি আরও পরিশীলিত করা হয় এবং বর্তমানে এর ধারা-উপধারাগুলো আরও শুদ্ধ করে তৈরি হচ্ছে। আমি অন্তত চারটি আইনের কথা বললাম, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের নদীগুলোর স্বাস্থ্য ও অবয়ব পুনরুদ্ধার তো সম্ভবই- একই সঙ্গে নদীগুলোর প্রাকৃতিক অবস্থাও পুনরুদ্ধার সম্ভব। এবারে আসি বাংলাদেশের নদীগুলোর দুরবস্থার কারণ নিয়ে আলোচনায়। প্রথমত, শিল্পপ্রতিষ্ঠান তথা বিভিন্ন কারখানা থেকে অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ নির্বিচারে নদীতে ফেলা হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা দূষণের জন্য হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়, পোশাক শিল্পও কম দায়ী নয়। দূষণকারীদের আরেকটি উৎস একেবারে আলোচনায় আসছে না। এটি হচ্ছে রাজধানীর কঠিন ও তরল বর্জ্য। রাজধানীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। পয়ঃনিষ্কাশন নালা থেকে সব তরল বর্জ্য প্রায় অপরিশোধিত অবস্থায় নদীতে পড়ছে। পাগলায় যে শোধনাগার আছে তার কার্যকারিতা অত্যন্ত সীমিত।
নদীদূষণে ট্যানারিসহ বিভিন্ন ধরনের কলকারখানা যেমন দায়ী, ঢাকা ওয়াসা এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এ ক্ষেত্রে কোনো অংশেই কম দায়ী নয়। প্রায় প্রতিটি নগরীর পাশের নদীটি অত্যন্ত দূষিত অবস্থায় আছে। এরপর রয়েছে নদী সংকোচন তথা নদীদখল। আমি বর্ষায় কানায় কানায় পূর্ণ নদীকে নদী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। শুষ্ক মৌসুমে, শুকিয়ে যাওয়া শীর্ণ নদীর যে অংশে পানি প্রবাহিত হচ্ছে কেবল ততটুকু নদী হিসেবে চিহ্নিত করাকে একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করতে চাই। অথচ আমাদের প্রশাসনযন্ত্র এ শুকিয়ে যাওয়া শীর্ণ নদীকেই নদী হিসেবে চিহ্নিত করে খুঁটি বসিয়ে যাচ্ছে। এর দায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের বড় কর্তারা, জেলা প্রশাসনের অধিকারিকরা কিছুতেই এড়াতে পারেন না। এখন আমরা দেখতে চাই নদী সংরক্ষণ আইন প্রয়োগকারীরা এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেন। একটি নদী কতটা ভালো আছে তা নিরূপণ করতে গেলে এর প্রশস্ততা সংকুচিত হয়েছে কি-না, নদীটির জীববৈচিত্র্য কতটা পরিবর্তিত হয়েছে এবং পানির গুণগত মান- এ তিনটি বিষয় পৃথক ও সম্মিলিতভাবে দেখতে হবে। নদীর পানির গুণগত মান নষ্ট হলে জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। বুড়িগঙ্গায় এখন আর শুশুক কিংবা ইলিশ পাওয়া যায় না। নদীর প্রশস্ততা কমার জন্য নদী দখলকারীরাই দায়ী। দেশের জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমির ওপর চাপ বাড়ছে এবং এ কারণে নদী দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। এ কাজটি যারা করেন, তারা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। এ অবস্থা চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের ছোট ও মাঝারি নদীগুলো হারিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। এ নদী যাদের মায়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাদের যথোপযুক্ত যতœ নেয়া তো দূরের কথা, তাদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার চলছে। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে নদীগুলোর মৃত্যু খুবই দুঃখজনক ফলাফল বয়ে আনবে। যে আইনগুলোর কথা বললাম এবং সংবিধানের যে ধারার উল্লেখ করলাম, তার প্রকৃত প্রয়োগ নদীগুলোকে বাঁচিয়ে তুলবে।
প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত : পরিবেশবিদ ও পানিবিশেষজ্ঞ, এমিরেটাস প্রফেসর, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়