দিনটি ছিল শনিবার…

১৯৭৫ সালের সেই দিনটি ছিল শনিবার। বঙ্গবন্ধু সপ্তাহে সাত দিনই অফিস করতেন। সেদিন অফিসে এসেই বললেন, আজ দেশের ভবিষ্যতের জন্য অনেক বড় একটি কাজ করতে যাচ্ছি।
আজ বাঙ্গালীর অন্যতম মুক্তির সনদে সই করবো। তার পরে সেই ফাইলে সই করেন। দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে তা অনেক ভূমিকা রেখে চলেছে। সেদিন রেখেছিল আজও তা অব্যাহত আছে।
জ্বালানি খাতের জন্য বঙ্গবন্ধু সর্বশেষ বড় কাজটি করে গিয়েছিলেন ৫টি গ্যাসক্ষেত্র জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে।
গ্যাস ক্ষেত্র ৫টি কিন্তু সহজে দিতে চায় নি বহুজাতিক কোম্পানি শেল। বঙ্গবন্ধু তাদের বলেছিলেন, দেখো তোমরা যদি না বিক্রি করো। তাহলে নতুন আইনে আমরা অধিগ্রহণ করতে বাধ্য হবো। পরে শেল বাধ্য হয়েছিলো। ইরানে তখন অধিগ্রহণের ঘটনা ঘটেছিল। শেল হয়তো সেটাই ভয় পেয়েছিল। বিদেশি কোম্পানি থেকে গ্যাসক্ষেত্র কিনে জাতীয়করণের এই কাজটি অতটা সহজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তাদেরকে গ্যাসক্ষেত্র অধিগ্রহণের হুমকিও দিয়েছিলেন। এর কয়েক দিনের মধ্যেই আততায়ীদের হাতে তিনি সপরিবারে শাহাদাত বরণ করলেন। ওই ঘটনার সঙ্গে এই শাহাদাতের সম্পর্ক আছে কি না আমি জানি না।
সম্পদের কারণে অনেককেই জীবন দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের সঙ্গে শেল এর এই গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে নেয়ার বিষয়টি জড়িত থাকলে আমি খুবই দুঃখ পাবো।
১৯৭৩ সালে দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়ে ১৭টি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে সই করা হয়েছিল। সেই সময় এসব চুক্তি থেকে সেলামি বাবদ অর্থ পেয়েছিল বাংলাদেশ। সমুদ্র সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগও নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেসময় সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু জ্বালানি খাতকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন।
সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে শিল্পায়ন ও বিদ্যুৎ জ্বালানির কথা। ৪৩ অনুচ্ছেদে জ্বালানি নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে বিদ্যুৎ প্রাপ্তি মৌলিক অধিকার করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে বিদ্যুৎ জ্বালানির ভূমিকা যে অনেক তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। সেই সময়ই তিনি এগুলো বুঝতে পেরেছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ গড়ে তুলতে বিদ্যুৎ-জ্বালানিকে অন্যতম গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। দেশের প্রথম বাজেটে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ১২ ভাগ বিনিয়োগ রাখা হয়েছিল বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে।
১৯৫৬ সালে সিলেটের হরিপুরে গ্যাস পাওয়া গেলো। তখন বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার শিল্পমন্ত্রী। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের মাটির নিচে অমূল্য সম্পদ লুকিয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু যখন মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিলেন তখন বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছিল— ‘তোমার দেশে তেল, গ্যাস এবং চিংড়ি আছে।’
বাংলাদেশের মাটির নিচে তেল-গ্যাস, সোনা-দানা রয়েছে এমন আশায় আশাবাদী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার পর প্রথম যে পঞ্চবার্ষিক কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল সেখানে চারটি প্রধান বিষয় ছিল কৃষি, শিল্প, পরিবহন এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন গ্রামকে উন্নত করতে। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে। সকল সুযোগ-সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দিতে। তাই সকল গ্রামকে আলোকিত করার কথা ভেবেছিলেন। ভেবেছিলে সব গ্রামে কিভাবে বিদ্যুৎ পৌছে দেয়া যায়। কাউন্টার পার্ট ফান্ড থেকে পল্লী বিদ্যুৎ করার কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু পল্লী বিদ্যুতায়ন করার জন্য আরইবি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
কিন্তু দেখে যেতে পারেন নি।
প্রধানমন্ত্রী জনবন্ধু শেখ হাসিনার অর্জণটা অনেক। ৯৭ ভাগ ঘরে বিদ্যুৎতায়ন করেছেন। মুজিববর্ষে শতভাগ ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হবে। শিল্পায়ন না হলে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান হয় না। সরকার সেটিকে সঠিকভাবেই নিয়েছে। আমরা উন্নয়নের এমন পর্যায়ে রয়েছি।
আমার কাছে মনে হয়েছে ২০০১ সালে শেখ হাসিনার বিজয়ের কোনো বিষয় ছিল না। কিছু ব্যবসায়ী তখন গ্যাস রপ্তানির কথা বলেছিলেন। শেখ হাসিনা সোজা বলেছিলেন আগে বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো। তার পরের ঘটনা সকলের জানা। ২০০১ থেকে ২০০৮ সালে সুশাসন হয়েছে এটা বলা যাবে না। দীর্ঘদিনের রুগ্ন মূলধন বাজার এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা দুর্নীতির কথা শুনেছি, এখন কিন্তু ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে। জনবন্ধু শেখ হাসিনার কারণে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে অগ্রাধিকারমূলক কাজ ছিল শিল্পায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন। তার কন্যা শেখ হাসিনার কাজের মাঝেও এর পূর্ণ প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শিল্পায়নের জন্য বিদ্যুৎ, গ্যাসের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিকল্প নেই।
কোভিড পরিস্থিতিতে আমাদের অর্থনীতি পথ হারায়নি। আমাদের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। অর্থনৈতিক এই উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভণর