জ্বালানি তেলের দাম কমালে লাভের হিসাব

বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে এখনো জ্বালানি তেল বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। বিশ্বে অপরিশোধিত তেলের দাম ক্রমান্বয়ে কমছে। এখনকার দাম বিগত ১১ বছরের সর্বনিম্ন। ব্যারেলপ্রতি কমবেশি ৩৫ ডলার। ২০১১ সালের জুলাই মাসেও তা ছিল ৯৫ দশমিক ৭০ ডলার। স্বাভাবিক নিয়মেই দাবি এসেছে দেশের বাজারে পরিশোধিত তেলের দাম কমানোর। দাবিটি আনুষ্ঠানিকভাবে এসেছে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকার সচেতনভাবেই এত দিন জ্বালানি তেলের দাম কমায়নি। সরকারের মনোভাব ছিল বিপিসির লোকসান কিছুটা সমন্বয় করা।’ এতে ধরে নেওয়া যায় যে তিনিও তেলের দাম কমানোর দাবিতে এখন অনুকূল মনোভাব দেখাবেন। আবার সরকারের কোনো কোনো মহল বলছে, লোকসান পুরোটা সমন্বয় হয়নি। অবশ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা এখনো কার্যক্রম সূচনার জন্য কোনো নির্দেশনা পায়নি। উল্লেখ করা যায়, এই মূল্যহ্রাসের ফলে জ্বালানি তেল খাতে আমাদের আমদানি শুল্কও হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি এক মূল্যায়নে বলেছে, জ্বালানি তেলের দাম ১০ শতাংশ কমানো হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। তৈরি পোশাক রপ্তানি আর ভোক্তা চাহিদাও বাড়বে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৪ এবং শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি আর সরকারের সঞ্চয় কমবে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ২ এবং শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। তাদের বক্তব্যকেও গুরুত্ব দিতে হয়। এ প্রসঙ্গে একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেছেন, ‘লিটারপ্রতি ডিজেলে ১০ ও অকটেনে ২০ টাকা কমানো হলে সরকারের মুনাফা খুব বেশি কমবে না। তবে আমরা ব্যবসায়ীরা একটু নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পাব।’ প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুসারে, সরকার প্রতি লিটার অকটেনে মুনাফা করছে প্রায় ৪০ টাকা। আর কেরোসিন, ডিজেল ও ফার্নেস তেলে ১৫ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। সিপিডি অবশ্য সম্পূর্ণ জ্বালানি তেলের দামই গড়ে ১০ শতাংশ কমানোর পক্ষে। আর এর পাশাপাশি সমন্বয় চায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দামে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উৎপাদন পর্যায়ে বড় একটি অংশই ব্যয় হয় এই জ্বালানি খাতে। এসব কথা খুবই যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী, সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে এতটা পড়তির পর দেশে জ্বালানি তেলের দাম এভাবে ধরে রাখার যৌক্তিকতা সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা যায়। এর মধ্যে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, যেসব দেশ তেল বিক্রয়লব্ধ আয়ের ওপর প্রধানত নির্ভর করে, তারা ঘাটতি মেটাতে আরও অধিক উৎপাদনে যাচ্ছে। ফলে আরও কমতে পারে এর দাম।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ পর্যন্ত দেশের যেটুকু অর্জন, এতে তাঁদের অবদান স্বীকার করতেই হয়। সেই অর্জনকে শুধু ধরে রাখতে নয়, জোরদার করতেও তাঁরা সক্রিয় রয়েছেন। তবে তাঁদের সব প্রচেষ্টাতেই সরকার, করদাতা জনগণসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা রয়েছে। খুব কম বেতনে শ্রমশক্তি পাচ্ছেন তাঁরা। করদাতাদের ব্যয়ে তৈরি করা অবকাঠামো অবদান রাখছে তাঁদের প্রবৃদ্ধিতে। রপ্তানিমুখী শিল্প খাত তো একধরনের করের আওতার বাইরেই থাকছে। ক্ষেত্রবিশেষে রয়েছে আর্থিক প্রণোদনা। এগুলোর আকৃতি ও প্রকৃতির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকলেও বিবেচ্য প্রসঙ্গে অনাবশ্যক। পাশাপাশি এটাও বলতে হয়, দেশের শিল্পায়ন ও রপ্তানি বৃদ্ধির স্বার্থে শিল্প ও ব্যবসা খাতে সম্ভাব্য সব সুবিধা দেওয়া আবশ্যক।
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবি করতে গিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা অকটেন ও ডিজেলের প্রসঙ্গই এনেছেন। হয়তোবা ভুলে গেছেন কেরোসিনের কথা। এখনো দেশের প্রায় অর্ধেক লোক দিবাশেষে এর আলোতেই কাজ চালায়। এদের বেশির ভাগই সমাজের নিম্ন আয়ের। এমনকি যে মহানগরীগুলো বিজলি বাতির রোশনাইয়ে ঝলমল করছে, তারও বস্তিবাসীদের অধিকাংশের আঁধারের সম্বল কেরোসিনের হারিকেন কিংবা কুপি। সুতরাং তেলের দাম কমানোর কথা এলে প্রথমেই তো অন্তত কেরোসিন সরকারের ক্রয়মূল্যে বিক্রি করার কথাটি বিবেচনায় নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে এটা তো ভর্তুকি মূল্যেই দেওয়া উচিত। অবশ্য ভর্তুকি তাদের ভাগ্যে খুব কমই জোটে। দেশের উন্নয়নের সুফলভোগীও তেমনভাবে তারা নয়। তবে তাদের আলো জ্বালানোর সামগ্রীটি থেকে লাভ না করে ক্রয়মূল্যে বিক্রি করার প্রস্তাবটি তো অসংগত বলা যাবে না। তারা বকশিশ চায় না। আমরা ভাগ্যবানরা তাদের হিসাবের পাওনাটুকু অন্তত মিটিয়ে দেওয়ার দাবি তুলতে পারি। বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য কমবেশি তারাও কেনে। অজান্তেই দিতে হয় মূল্য সংযোজন কর বা আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়করের অংশবিশেষ। কেরোসিনের আমদানি শুল্কও তাদের ওপরই বর্তায়। সুতরাং তারাও দেশের করদাতা জনগণ বটে।
এরপর আলোচনা করা যায় অন্য জ্বালানি তেলগুলোর মূল্য কমানোর প্রস্তাব নিয়ে। এই কমানোর সুফল জনগণের বৃহত্তর অংশকে ভাগীদার করতে না পারলে যথার্থ হবে না। অকটেন মূলত দেশের ধনিক সম্প্রদায়ের গাড়ির জ্বালানি। তাই বলে এর দামও অসংগতভাবে ধরে রাখা ঠিক নয়। আর ডিজেল! এর ব্যবহার কিন্তু ব্যাপক। বাস-ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমারসহ বিভিন্ন নৌযান, সেচ মেশিন ও কলের লাঙল চালাতেও ব্যবহৃত হয় ডিজেল। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও এর ব্যবহার রয়েছে। জনগণের বিশাল একটি অংশ এর দাম বাড়া-কমার ওপর নির্ভরশীল, এমনটা আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে। দেখা যায়, ডিজেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা রাতে হলে পরদিনই বাস, ট্রাক আর জলযান সরকারের কোনো অনুমোদন ছাড়াই বাড়িয়ে দেয় ভাড়া। আর সেই বৃদ্ধির পরিমাণও যৌক্তিকতার সঙ্গে সম্পর্কবিহীন। একপর্যায়ে সরকার দৃশ্যে আসে। নতুন করে নির্ধারিত হয় ভাড়া। আর তা–ও অনিবার্যভাবে যায় পরিবহনের মালিকদের পক্ষে। ট্রাকের ভাড়া মূলত বাজার অর্থনীতিই নিয়ন্ত্রণ করে। আর প্রকৃতপক্ষের এর নিয়ন্ত্রক ট্রাকমালিক আর চালকেরা। পণ্যমূল্য যায় বেড়ে। ডিজেলের দাম কমানো হলে বাসের যাত্রীভাড়া আর ট্রাকের মালামাল পরিবহন ব্যয় আনুপাতিক হারে কমবে, এর নিশ্চয়তা বিধান করা যাবে কি? পরিবহনের মালিক ও শ্রমিকেরা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছেন। তা সত্ত্বেও বলতে হয়, এ খাতে সরকারের আইনকানুন প্রয়োগের মাত্রা খুব শিথিলই থাকছে। এরপর আসে সেচ পাম্প ও কলের লাঙলের কথা। নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, এগুলোর মালিক হয়তোবা ধনী কৃষক অথবা একশ্রেণির ব্যবসায়ী। বেনামে হলেও একটি ‘পানি জমিদার’ শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে আমাদের কৃষি খাতে। ডিজেলের দাম কমানো হলে ক্ষুদ্র কৃষকেরা কম দামে পানি আর কম ভাড়ায় কলের লাঙল পাওয়ার কথা। এটাও নিশ্চিত করা যাবে কি? অবশ্য কাজটি সহজসাধ্য নয়। তবে ডিজেলের দাম বাড়লেই এগুলোর ভাড়া বেড়ে যায় রাতারাতি। মাশুল গুনতে হয় ক্ষুদ্র কৃষকদের। ডিজেলনির্ভর যে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র রয়েছে, তাদেরও মূল্য সমন্বয় করতে সরকার বাধ্য করতে পারবে কি না, এটা নিয়েও সংশয় রয়েছ। জ্বালানি তেলের দাম কমলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামও ভোক্তা পর্যায়ে কিছুটা কমার কথা। এসব দিক বিবেচনায় না রাখলে এ ধরনের মূল্যহ্রাসের অংশীদার জনগণের ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী হবে।
হয়তো বলা হবে, এত সব খুঁটিনাটি দেখতে হলে জ্বালানি তেলের দাম কমানো যাবে না। সৃষ্টি হবে না ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ। আমরা অবশ্যই ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ চাই। শিল্পায়ন কর্মসংস্থান বাড়াবে। এতে বাড়বে ভোক্তার চাহিদাও। বৃদ্ধি পাবে রপ্তানি। কিছুটা কমতে পারে মূল্যস্ফীতি। তবে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণের পরিমাপকের সঙ্গে আমাদের বাজারের ফারাক রয়েছে অনেক। যেকোনো অজুহাতে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যমূল্য বাড়ে। আর সেই বাড়ার রীতিটিও লক্ষ করার মতো। ২০ থেকে ২৫, ৩০, ৩৫, ৪০ হয়। ২০, ২১, ২২ হয় না। মনে হয় ৫ টাকাই আমাদের মুদ্রার সর্বনিম্ন ইউনিট হয়ে গেছে। প্রস্তাবের পক্ষে সিপিডির আর্থিক সূচকগুলোকেও অস্বীকার করা যায়
না। অন্যায্য বলা যাবে না ব্যবসায়ীদের দাবিকে। তবে এই কমানোর অংশীদার সমাজের বৃহত্তর জনগণকে করার যৌক্তিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। বিবেচনায় থাকা দরকার যে রাষ্ট্রটি আমাদের সবার।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

সৌজন্যে: প্রথম আলো