করোনাভাইরাস: মন্দার ঘণ্টা বাজছে বিশ্ব অর্থনীতিতে

মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক চীনের অর্থনীতিতে দুর্যোগ নামার পর আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে রেস্তোরাঁ, দোকানপাট, বিমান চলাচল ও কারখানা বন্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিশ্বমন্দা আর আশঙ্কা নয়, বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

সোমবার চীন অর্থনৈতিক দুরবস্থার যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে বিশ্লেষকদের ধারণার চেয়েও বাজে চিত্র ফুটে উঠেছে। ১৯৮৯ সালে জিডিপির প্রান্তিক তথ্য প্রকাশ শুরুর পর প্রথম ধসের মধ্যে পড়ল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আঘাতে জর্জরিত দেশটির শিগগরিই পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

এখন এই মহামারী নিয়ন্ত্রণে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি যখন কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে এশিয়া, আর্থিক বাজারগুলিতে নেমেছে ধস, তখন বেশি সংখ্যায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধসের সূচনা হচ্ছে।

ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ডের গবেষণা ও পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক প্রধান ডেভিড উইলকক্স সিএনএন বিজনেসকে বলেন, “১০ দিন আগেও বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে মোড় নিচ্ছে কিনা তা নিয়ে বাস্তব অনিশ্চয়তা ছিল, কিন্তু এখন এটি নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন নেই।”

দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশ

গত সপ্তাহে নভেল করোনভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা পৌনে দুই লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর বিশ্বজুড়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে; মহামারী নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা, কারফিউ জারি ও জনসমাগম বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনেক দেশ। চীনে ক্ষতির মাত্রা ক্রমেই স্পষ্ট হওয়ার পর নেওয়া এই পদক্ষেপগুলির ফলে অর্থনীতির মারাত্মক ধাক্বা খাবে।

এ বছরের প্রথম দুই মাসে কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার কারণে চীনা অর্থনীতির প্রতিটি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারিতে চীনের খুচরা বিক্রি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। অথচ ব্লুমবার্গের জরিপে ৪ শতাংশ হারে কমার এবং রয়টার্সের জরিপে উল্টো দশমিক ৮ শতাংশ বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন বিশ্লেষকরা।
এই দুই মাসে দেশটির শিল্প উত্পাদন সাড়ে ১৩ শতাংশ এবং স্থায়ী সম্পদ বিনিয়োগ প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে। শিল্প উত্পাদন কমার এই হার চীনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের গ্লোবাল ম্যাক্রো রিসার্চের পরিচালক বেন মে সিএনএনকে বলেন, চীনের সবকিছু বন্ধ করার প্রভাব এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। অন্য দেশগুলোতে পরিস্থিতি যদি ভিন্নও হয় প্রবৃদ্ধির ক্ষতি এড়ানো যাবে না।

বিপর্যস্ত চীন যখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই করছে, তখন ইউরোপ ও আমেরিকায় পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। নভেল করোনাভাইরাসের নতুন কেন্দ্রস্থল ইতালিতে ২৪ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত। স্পেনে কমপক্ষে নয় হাজার ও যুক্তরাষ্ট্রে চার হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।

গোল্ডম্যান স্যাকস রোববার যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমার পূর্বাভাস দিয়েছে; কারণ হিসেবে মোট ব্যয় হ্রাস, সরবরাহ শৃঙ্খলে বিপর্যয় ও স্থানীয় কোয়ানেন্টিনের কথা উল্লেখ করেছে।

জানুয়ারি-মার্চ সময়ে কোনো প্রবৃদ্ধি না হওয়ার পর এপ্রিল-জুন সময়ে প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হারে কমবে বলে মনে করছে বিনিয়োগ ব্যাংকটি। হালনাগাগাদ পূর্বাভাসে পুরো বছরের প্রবৃদ্ধির ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ ধরা হয়েছে।

এই ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জান হাটজিয়াস ক্লায়েন্টদের বলেছেন, এই অচলাবস্থা ও ভাইরাসটি নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের প্রভাবে মার্চের বাকিটা ও এপ্রিলজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক হারে কমতে পারে।
২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের সময়ের মন্দার মতো দ্বিতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ৮ শতাংশ সঙ্কুচিত হবে বলে মনে করছেন আইএনজির অর্থনীতিবিদরা।

সাধারণত টানা দুই প্রান্তিক বা তার বেশি সময় পতনশীল জিডিপি পরিস্থিতিকে মন্দা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যেটা ২০২০ সালে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপেক্ষা করছে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন আইএইচএস মার্কিটের প্রধান মার্কিন অর্থনীতিবিদ জোয়েল প্রাক্কেন।

বাজারে বিপর্যয়

এরমধ্যে সাম্প্রতিক দিনগুলিতে আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে; বাজারের চরম অস্থিরতার মধ্যে ক্রেতা-বিক্রেতাদের পক্ষে সম্পদের দাম নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে উঠছে। এর ঘাত বাস্তব অর্থনীতিতে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ স্টক পোর্টফোলিও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভোক্তারা ঘাবড়ে গেছেন এবং সেই সঙ্গে ব্যবসার অর্থ ধার করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার সর্বোচ্চ অবস্থানে যাওয়ার পর গত এক মাসের উল্টো রথে ২৭ শতাংশ দর হারিয়েছে।

পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের আনাবাসী জ্যেষ্ঠ ফেলো উইলকক্স বলেন, ইদানিং যে বিষয়টি সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো- আর্থিক বাজারের চলমান প্রতিকূল পরিস্থিতির পরিবর্ধক হয়ে উঠার উচ্চ ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে।
স্বল্পমেয়াদী ঋণ বাজারের উপর বর্তমান চাপকে প্রধান উদ্বেগের বিষয় হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, “হৃদযন্ত্র ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এড়িয়ে এই বাজারগুলির কার্যক্রম অব্যাহত রাখা জরুরি।”

অর্থনীতির যন্ত্রণা লাঘবে রোববার যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছে- বেঞ্চমার্ক সুদের হার কমিয়ে শূন্যের কাছাকাছি নামিয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলির জন্য সস্তায় মার্কিন ডলার কেনার সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

সোমবার চলমান সহযোগিতার সঙ্গে আর্থিক বাজারে আরও ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে নিউ ইয়র্ক ফেড। আর্থিক বাজারের বিপর্যয় যে পরে বিস্তৃত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতটা উদ্বিগ্ন তার নিদর্শন এটা।

শেয়ারবাজার যখন ডুবন্ত, ঋণ বাজার যখন চড়াই-উৎড়াইয়ে এবং তারল্য সংকট যখন চরমে, তখন বৈশ্বিক মন্দা যে শুরু হয়েছে সে সেবিষয়ে সবাই একমত হচ্ছেন। এখন প্রশ্ন শুধু- পরিস্থিতি কতটা খারাপ হবে।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাবেক শীর্ষ অর্থনীতিবিদ কেভিন হাসেট সিএনএনের পপি হারলোকে বলেন, “শতভাগ বৈশ্বিক মন্দার পরিস্থিতির প্রায় কাছাকাছি আমরা।”