রাজনৈতিক নয় অর্থনৈতিক বিবেচনায় করতে হবে

ভারতের দুই কোম্পানির সঙ্গে যথাযথ দরকষাকষির মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে চুক্তি করা উচিত। রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বের হয়ে পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলেও সুযোগ সুবিধার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে করতে হবে।
সম্প্রতি ভারতের দুই কোম্পানির সাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সমঝোতা হওয়ার বিষয়ে এমনই মন্তব্য করেছেন স্থানীয় উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, যুদ্ধকালিন অবস্থা বিবেচনায় বিশেষ আইন করা হয়েছিল। সে পরিস্থিতি এখন নেই। এই অবস্থায় বিনা প্রতিযোগিতায় বিদেশী কাউকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে দেয়া উচিত হবে না। দেশীয় কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাজ করছে। বিশেষ কোন সুবিধা পাচ্ছে না। আর বিদেশী কোম্পানি সেই সুবিধা পাবে। এটা ঠিক হবে না। প্রতিযোগিতা ছাড়া কাজ দিলেও সকল অর্থনৈতিক বিষয় পর্যালোচনা করেই এই চুক্তি করা উচিত।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বিনা প্রতিযোগিতা কিংবা টেন্ডার ছাড়া কাজ দেয়া হলেও, চূড়ান্ত চুক্তি যেন ভালভাবে করা হয়। এক্ষেত্রে যেন দেশের মধ্যে বর্তমানে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আছে তাদের চেয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা না হয়। তারা বলেন, বাংলাদেশে যেহেতু বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি এজন্য বিদেশী কেউ কেন্দ্র করলে ভালই হবে। তাছাড়া বাংলাদেশে প্রাথমিক জ্বালানির ঘাটতি আছে। সে অবস্থান থেকে পিডিবি যে জ্বালানি দিতে পারবে না বলে দিয়েছে এটি ভাল দিক। কয়লা ও এলএনজি আমদানি করে এই কেন্দ্র করা হবে।
গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ভারতের রিলায়েন্স ও আদানি গ্রুপের সাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সমঝোতা চুক্তি করেছে। প্রাথমিকভাবে পিডিবি সম্মত হয়েছে তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার। একই সাথে দেশের গ্রহণযোগ্য স্থানে কেন্দ্র স্থাপনের জমিও দেয়া হবে। তবে কোথায় হবে তা এখনও ঠিক হয়নি। ঠিক হয়নি বিদ্যুতের দামও। চূড়ান্ত চুক্তির সময় এসব ঠিক হবে। বাংলাদেশে যত বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে প্রায় সকল কেন্দ্রের জন্য পিডিবি জ্বালানির নিশ্চয়তা দিয়েছে। অর্থাৎ পিডিবি সকল কেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ করে। কিন্তু এই দুই কেন্দ্রে জ্বালানি নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। তারা নিজেরাই নিজেদের জ্বালানি সংগ্রহ করে নেবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি’র বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশের সাথে ভারতের বিদ্যুৎ-জ্বালানি বিনিময়ে কয়েকটি চুক্তি হয়। সে সময় ভারতকে বাংলাদেশ বিদ্যুতের করিডোর দিয়েছে। বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে উচ্চ ক্ষমতার বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন করবে ভারত। ভারতের উত্তরপূর্ব থেকে পূর্ব দিকে তারা এই সঞ্চালন লাইন দিয়ে বিদ্যুৎ নেবে। এছাড়া ভারত থেকে পাইপে করে জ্বালানি তেল আমদানি এবং নেপাল, ভূটান থেকে বাংরাদেশে বিদ্যুৎ আনতে ভারত করিডোর দিতে সম্মত হয়েছে।
ভারতের রিলায়েন্স ও আদানি বাংলাদেশে চার হাজার ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কেন্দ্র স্থাপন করতে এই সমঝোতা করেছে। এজন্য প্রায় চার দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে তারা। এছাড়া এলএনজি আমদানির জন্য একটি ভ্রাম্যমান টার্মিনাল স্থাপন করবে। চূড়ান্ত চুক্তির ৩০ মাসের মধ্যে এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে জানানো হয়েছে।
বিদ্যুৎ উল্পুয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনাইটেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মঈদ উদ্দীন ভারতের এই দুই কোম্পানিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ২০ হাজার মেগাওয়াট। তখন অনেক বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, যে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জন্য সমঝোতা করা হয়েছে তা বিশেষায়িত। একটি কয়লাভিত্তিক অন্যটি এলএনজি। দুটির কোনটিই বাংলাদেশে নেই। এটা করলে দেশেরই উপকার হবে। তবে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করতে হবে যথাযথভাবে। প্রতিযোগিতা ছাড়াও বিদ্যুৎ কেন্দ্র দিলে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু দাম যেন ঠিক থাকে। বিশেষ কোন সুবিধা যেন দিয়ে দেয়া না হয়। পেশাদারিত্ব বজায় রেখে যেন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করা হয়। বাংলাদেশে এখন উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। যেমন করেই হোক বাড়লেই ভাল। জ্বালানি বৈচিত্র দরকার। গ্যাস করেছিলাম। কয়লা যদি শুরু হয় তবে ভাল। এটা দরকার।
সামিট পাওয়ার এর পরিচালক আয়েশা আজিজ খান বলেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদায় বিদেশীদের দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যেতেই পারে। তবে দেখতে হবে তাতে যেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা বঞ্চিত না হয়। একই সাথে ভারতেও বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা যেন কাজ করার সুযোগ পায়, সে বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, বিশেষ আইনের সুফল স্বল্প মেয়াদে পাওয়া গেছে। এখন দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সে আইন ব্যবহার করা ঠিক হবে না। তাছাড়া সময়ের চেয়ে এখন সাশ্রয়ী দামের দিকে বেশি নজর দেয়া উচিত।
সমঝোতা অনুযায়ি, রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেড ৭৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার চারটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবে। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার মেগাওযাট। সবগুলো কেন্দ্রই হবে গ্যাস ভিত্তিক। তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো হবে। এজন্য এলএনজি রি-গ্যাসিফিকেশন টার্মিনাল করবে রিলায়েন্স। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে।
আদানি পাওয়ার লিমিটেড ৮০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। আমদানি করা কয়লা দিয়ে এই কেন্দ্র চলবে। মহেশখালি বা গ্রহণযোগ্য অন্য কোথাও এই কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
এছাড়াও বাংলাদেশের জন্য ভারতে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সমঝোতা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।