চোখের সামনে সর্বোচ্চ প্রয়োজনের সময় কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেল দেশের সবচেয়ে বড় এবং নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র। ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার পায়রা কেন্দ্র। এর প্রথম ইউনিট বন্ধ হয়েছে আরও আগে। বাংলাদেশ চায়না যৌথবিনিয়োগে নির্মিত কেন্দ্রটির দ্বিতীয়টিও বন্ধ হলো।
এতে বিদ্যুৎ ঘাটতি বেড়েছে।
তবে চলমান সংকটের জন্য শুধু পায়রা দায়ী নয়। রামপালে উৎপাদন কম। বড়পুকুরিয়ায় অর্ধেক। অর্ধেক উৎপাদন তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলোতেও।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ডলার সংকটে এই অবস্থা। যদি তাই হয় তবে এখন কোথা থেকে ডলার এলো?
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রর কয়লার জন্য প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া আছে। চুক্তি অনুযায়ী পায়রার জন্য সব সময় ছয় মাসের বকেয়া রেখে কয়লা সরবরাহ করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিএমসি। এই ছয় মাস পরে আরও প্রায় তিন মাসের বকেয়া পড়েছে। তাতেই কয়লা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে তারা।
বিষয়টি কয়েক মাস আলোচনা চলছে। কিন্তু সমাধান হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক যথাসময়ে ডলার দেয়নি। কিছুদিন আগে ঐ দেনার একশ’ মিলিয়ন ডলার পর্যায়ক্রমে শোধ করবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতেই সুযোগ তৈরি হয়েছে নতুন করে কয়লা আনার।
ইতিমধ্যে কয়লার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আসবে। এক এক জাহাজে ৪০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা আসবে। প্রথম জাহাজ দেশে এসে পৌঁছবে এমাসের শেষে। পর্যায়ক্রমে এভাবে জাহাজ আসতে থাকবে।
ঐ বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারী বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, জুনের শেষের দিকে দেশে কয়লা চলে আসবে। আর কয়লা এলেই কেন্দ্র চালু হবে। দুই মাস পর পায়রা রক্ষণাবেক্ষণের কথা ছিল। সেটা এই বন্ধের মধ্যে করে নেওয়া হবে। আপাতত কয়েক মাসের কয়লার সংস্থান হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এই যে উদ্যোগ, যার কারণে এখন কয়লা আসছে – সেটা যদি এপ্রিল মাসে নেওয়া যেত; যে একশ’ মিলিযন ডলার এখন দেওয়া হলো তা যদি এপ্রিল মাসে দেওয়া যেত তবে এমন ঘটনা ঘটতো না। পায়রা বন্ধ হতো না। বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময়, সর্বোচ্চ গরমের সময় এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হতো না। সমস্যা থাকলে তা কোনোভাবে শীত পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে বন্ধ রাখলে মানুষের এত কষ্ট হতো না।
পায়রা নিয়ে কেন এত আলোচনা? কারণ এটি নির্ভরযোগ্য বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা একটানা চলতে পারে। ২৪ ঘণ্টায় সমানতালে একইভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। যা অন্য অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে পারে না। তাই, সংকটের মধ্যে এই বিদ্যুৎকন্দ্র উৎপাদনে থাকলে ভালো হতো।
এবারের লোডশেডিং এর অন্যতম কারণও কিন্তু এটাই যে, ২৪ ঘণ্টা একটানা চাহিদা বেশি থেকেছে। অন্য সময়গুলোতে দিনে বা গভীর রাতে চাহিদা কম থাকে। সন্ধ্যায় বেশি। কিন্তু এবার অস্বাভাবিক গরম হওয়ায় দিনে রাতে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় সমান তালে বিদ্যুৎ লেগেছে। এটা সংকটের অন্যতম কারণ।
এই উদ্যোগ কেন আগে নেয়া হয়নি? প্রশ্ন ছিল বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কাছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ অবশ্য এর উত্তরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আরও দুই মাস আগেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আর্থিক সংকটে তা সমাধান করা যায়নি।
শুধু ডলার সংকটকে অজুহাত দিলে হবে না। অব্যবস্থাপনা, গাফিলতি আর অদুরদর্শি সিদ্ধান্ত এর জন্য যে দায়ী নয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
আরও আগেই এই অবস্থা হতে পারে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
শুধু যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ সেটা নয় সাথে এই বন্ধের জন্যও পায়রা কর্তৃপক্ষকে জরিমানা (ক্যাপাসিটি চার্জ) গুণতে হবে আর তা কিন্তু দিতে হবে ডলারেই। অর্থাৎ বিদ্যুৎ পেলাম না; দায় শোধ হলো না; অথচ ডলার ঠিকই দিতে হবে।
শুধু পায়রা নয় অন্য সব বিদ্যুৎকেন্দ্রর বকেয়াও ভবিষ্যতের শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বকেয়া পড়ে আছে। অর্থবিভাগ সে টাকা ঠিকমত দিচ্ছে না। এতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কম।
ভবিষ্যতে যেন এমন আর না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
তাছাড়া এখন কয়লার দাম গত বছরের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। তাই প্রয়োজনের সাথে মজুদ বাড়িয়েও রাখা যেতে পারে।
Prev Post
Next Post