ইউনেসকোর প্রতিবেদনের জবাব: বন্ধ হবে না রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র

রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রর প্রযুক্তি নিয়ে ইউনেসকো যা বলেছে তা ঠিক নয়। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতেই এই কেন্দ্র হবে। এছাড়াও ইউনেসকোর প্রতিবেদনে অনেক ভুল আছে।

ইউনেসকোর খসড়া প্রতিবেদনের জবাবে এমনই উত্তর দিয়েছে বাংলাদেশ। পরিবেশ মন্ত্রনালয় থেকে এই উত্তর দেয়া হয়েছে।
পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এ ব্যাপারে বলেন, ‘ইউনেসকোর প্রতিবেদনের জবাব সোমবার পাঠিয়ে দিয়েছি। ইউনেসকোর প্রতিবেদনে পয়েন্ট আকারে যেসব বিষয় নিয়ে উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছিল বাস্তবতার সঙ্গে সেসবের মিল নেই। আমাদের পক্ষ থেকে জবাবে সেসব বিষয়ই তুলে ধরা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে জবাবে বলা হয়েছে,
ইউনেসকোর প্রতিবেদনটি যৌক্তিক নয়। এতে তথ্যগত ভুল আছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ বন্ধ করারও কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এই কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে সুন্দরবন-সংশ্লিষ্ট এলাকার সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। এতে সুন্দরবনের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমবে। ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কেন্দ্রটি গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ইউনেসকোর প্রতিবেদনের জবাব হিসাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, নৌ ও পরিবহন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ৩০ পৃষ্ঠাসংবলিত একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গতকাল সোমবার তা ইউনেসকোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো সম্প্রতি সরকারের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলেছে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে। বিশেষত পানি, বায়ু ও মাটির ক্ষতি হবে। এতে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীর জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ, সুন্দরবনের প্রাণী ও প্রতিবেশ সংকটে পড়বে। এ কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। সুন্দরবনের ক্ষতি করবে না এমন স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সরিয়ে নিতে হবে। এই সুপারিশ না মেনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখলে ২০১৭ সালে অনুষ্ঠেয় ইউনেসকোর ৪১তম অথিবেশনে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। একই সঙ্গে আগামী ১৩ অক্টোবরের মধ্যে সরকারকে এর জবাব দিতে বলা হয়।

সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউনেসকোর প্রতিবেদনটিতে দেওয়া তথ্য কোনোভাবেই প্রমাণ করে না যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে তথ্য ও ধারণাগত ভুল রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে পানি, বায়ু ও মাটির কোনো ক্ষতি হবে না। কেন্দ্রটি সর্বাধুনিক আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি বিশ্বব্যাংক ও আইএফসিহ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্দেশনা মেনেই করা হবে। এ কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পায়নি সরকার।

ইউনেসকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা পোড়ানোর কারণে তৈরি হবে সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও মার্কারি। এসবের কারণে এসিড বৃষ্টি হবে। ফলে মারা যাবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ। এর জবাবে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনের এ তথ্য বস্তুনিষ্ঠ নয়; এতে তথ্যগত ভুল আছে। কারণ এসিড বৃষ্টি সৃষ্টি হতে পারে এমন গ্যাস বাতাসে নির্গত হলে তবেই এসিড বৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে এসিড বৃষ্টির মূল উপাদান নাইট্রাস অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড এফজিডি (ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন) যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে।

ইউনেসকো বলেছে, কেন্দ্রটি থেকে বছরে গড়ে ১০ লাখ টনের বেশি ছাই উৎপাদিত হবে। আর কয়লা পোড়ানো ছাই অতিমাত্রায় বিপজ্জনক। কারণ এতে আর্সেনিক, সিসা, পারদ, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, বেরিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সিলেনিয়াম ও রেডিয়াম আছে। এসব পদার্থ মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। জবাবে বলা হয়েছে, তথ্যটি বস্তুগতভাবে ঠিক নয়। কারণ রামপাল কেন্দ্রে ব্যবহার করা কয়লা উন্নতমানের এবং এতে কম মাত্রার সালফার থাকবে। ফলে কেন্দ্রে ১০ লাখ টন নয়, বছরে ছয় লাখ টন ছাই উৎপাদিত হবে। আর এসব ছাইয়ের পুরোটাই সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া কেন্দ্রে ইলেকট্রো স্ট্যাটিক প্রিসিপেটর (ইএসপি) ব্যবহার করা হবে, যার মাধ্যমে ছাই বাতাসে ওড়া শতভাগ বন্ধ করা সম্ভব হবে।

ইউনেসকোর আপত্তি ছিল রামপাল কেন্দ্রে ব্যবহার করা প্রযুক্তি নিয়ে। তারা বলেছিল, রামপালে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে না। এর জবাবে সরকার বলেছে, তথ্যটি ঠিক নয়। রামপালের জন্য সর্বাধুনিক আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে এখান থেকে ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হবে না।

এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইউনেসকো বলেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরুর আগেই ইআইএ প্রতিবেদন করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হয়নি। এর উত্তরে বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষে ইআইএ প্রতিবেদনের ছাড়পত্র দিয়েছে। কাজ শুরু করার আগে ইআইএ অনুমতি দেয়নি।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই ঠাণ্ডাপুকুরে রেখে কেন্দ্রের বিভিন্ন নির্মাণকাজে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে মর্মে ইউনেসকোর উদ্বেগের জবাবে বলা হয়েছে, ঠাণ্ডাপুকুর নামের কিছু রামপাল প্রকল্পে নেই। এখানকার ছাই সিমেন্ট কারখানা, রাস্তা নির্মাণ ও ইটভাটার জন্য বিক্রি করা হবে। এটি পরিবহন করা হবে পুরো আচ্ছাদিত অবস্থায় ট্রাকের মাধ্যমে বা নৌপথে। শতভাগ ছাই-ই বিক্রি হয়ে যাবে। কোনো পরিস্থিতিতে ছাই কিছুদিনের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাখতে হলেও তা থাকবে অত্যন্ত সুরক্ষিত ছাই রাখার পুকুরে। তা বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ারও ঝুঁকিমুক্ত।

‘কেন্দ্রে ৯০০ ফুট উঁচু চিমনির ব্যবহার আশপাশের দূষণ রোধে সহায়তা করলেও দূরে দূষণ ও এসিড বৃষ্টি ঘটাবে। আর কেন্দ্রের ধোঁয়া বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে সুন্দরবনের ক্ষতি করবে।’ ইউনেসকোর এমন অভিযোগের জবাবে বলা হয়েছে, বছরের বেশির ভাগ সময় বায়ুর গতি সুন্দরবনের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুধু বাতাস উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। তবে এ সময় প্রবাহিত বাতাস সুন্দরবন রক্ষায় প্রাকৃতিক বর্ম হিসেবে কাজ করবে। উঁচু চিমনিতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের বিষয়ে সমীক্ষা না হওয়া নিয়ে ইউনেসকোর বক্তব্যের জবাবে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় ইউনিটটি এরই মধ্যে বাতিল করা হয়েছে।

পশুর নদ থেকে পানি টেনে নিয়ে দূষিত গরম পানি নদীতে ছেড়ে দেওয়া প্রসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রামপাল কেন্দ্রে ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) ব্যবহার হবে। এর মাধ্যমে নদী থেকে টেনে নেওয়া লবণাক্ত পানি ব্যবহারের পর লবণমুক্ত অবস্থায় শীতল ও শুদ্ধ করে নদীতে ছাড়া হবে। তা ছাড়া পশুর নদের মোট প্রবাহের (শুষ্ক মৌসুমের হিসেবে) মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পানি কেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে। আর একই পানি বারবার ব্যবহার করা হবে। ফলে পশুর নদের প্রবাহে টান পড়ার সুযোগ নেই।

ইউনেসকো বলেছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা প্রকল্প এলাকায় নেওয়ার জন্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বেড়ে যাবে। এতে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে। এ ছাড়া নৌপথটির নাব্য ঠিক রাখতে ৩৫ কিলোমিটার নদী খনন করতে হবে। আর খনন করা তিন কোটি ২০ লাখ টন মাটি ফেলা হবে সুন্দরবনের ভেতরে। এতে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

ইউনেসকোর এমন উদ্বেগের জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মংলা বন্দর থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকার দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। এই নৌপথটিই খনন করা হবে। এ বিষয়ে একটি ইআইএ করছে নৌ অধিদপ্তর।

ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে বাংলাদেশ : ইউনেসকোর প্রতিবেদনে ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে ভাটিতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের নদ-নদী ও সুন্দরবনকে লবণাক্ততা থেকে বাঁচাতে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বলা হয়েছে, গঙ্গার পানি পেতে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক এক চুক্তি সই করেছে ভারতের সঙ্গে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ন্যায্য পানি পাচ্ছে। আর বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেটি বাস্তবায়ন হলে সুন্দরবনের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।